“কেমন আছো?”
“ভালোরে ভাই।” মুখে হাসি নেই, চোখের সেই ঝিলিক নেই, শরীরের সেই ভাষা নেই।
“কোথায় থাকিস?”
“বনে জঙ্গলে।”
আমাকে আজাদ ভাই এবং উনার মতো আরও অনেকে ভদ্র ছেলে হিসেবে জানে। কিন্তু এখন এই ছেলে যে খানিকটা বাউরা হয়েছে তা উনাদের জানা নেই। আর থাকবেই বা কী করে? বছরে দু বার বা তিন বার দেখা হয়।তাও আবার দু একদিনের জন্য।ফলে এরকম উত্তর পেয়ে আজাদ্ ভাই কিছুটা উশখুশ করে।
“কার কাছে খাও না নিজে করো?”
“তোর ভাবি মারা যাওয়ার পর থেকে কিছুদিন নিজে। পরে হ্যাবল ও সাত্তার আমকে ভাগ করে নিয়েছে। দু সপ্তা ছোট ছেলে আর দু সপ্তা বড়োর কাছে। ভালো নাইরে ভাই। আছি কোনরকম। চলে যাচ্ছে।”
“চলো চা খাই।”
আমার ডাকে উনার মুখ কিছুটা উদ্ভাসিত হলো। পাকুড় গাছতলা থেকে বাড়ি আসলাম।
মা একবাটি মুড়ি আর চা দিলে আমরা উঠানে বসে পিঠে সকালের মোলায়েম রোদ লাগিয়ে গল্প করতে থাকলাম।
“শরীর কেমন যাচ্ছে?”
আজাদ ভাই একসময় বাঘ আর গরুকে একঘাটে জল খাওয়াতো। দূর দূর থেকে কবাডি খেলার জন্য তার অগ্রিম বুকিং থাকত। একবার ঘাট থেকে সকাল সকাল বাইশ কেজি বোয়াল ঘাড়ে করে নিয়ে আসার দৃশ্য আমাদের চোখে এখনও সবুজ। মনে হয় এই সে দিনকার কথা। আর সেই মানুষটি একেবারে নিস্তেজ, নিস্প্রভ।চোখে ভাল আর দেখতে পায়না, কিন্তু চশমার ব্যবহার এখনও করে না। ঝামেলা অনেক। মুখ হাত ধুতে গেলে বার বার খুলতে হয়! কী দরকার? দিন তো আর থেমে নেই।দূরের মানুষ বা গাছগাছালিকে ঝাপসা লাগে ঠিকই। কিন্তু মানুষ পাশে বসলে বা সে নিজে গাছের কাছে গেলে সখ্যতা যে এখনও অটুট রয়েছে সে বুঝতে পারে। আর তখন খানিকটা হলেও মনের ভার হাল্কা হয়। প্রাণে ঝিরি ঝিরি বাতাস লাগে। আবার সব চেনা মনে হয়। নিজের জগতে সে আপন মনে বিচরণ করতে থাকে। আর কি সব বিড় বিড় করে। আর অশ্রুধারা এবড়ো খেবড়ো গাল বেয়ে আপন গতিতে প্রবাহিত হয়ে পায়ের ধূলাকে সিক্ত করে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজাদ ভাই বলে, “এই না মরে বেচে আছি।দিন রাতের ফারাক দেখি না। মিথ্যা কথা বলবো না। ছেলেরা, বৌমারা খুব দেখে।সকালে বেশিরভাগ না খেয়ে থাকি। দুপুরে যা ছেলেদের জোটে তাই দিয়ে দু গ্রাস মুখে দিই। রাতে কোনোদিন এক খুরি মুড়ি আর তাও না জুটলে এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ি।কিন্তু ঘুম আসেনারে ভাই। কি যে করি? এই ভাবি মনে মনে।আর গা হাত পা ব্যাথা বিষ। একভাবে পাঁচ মিনিট বসে বা দাড়িয়ে থাকতে জান বেরিয়ে যায়। জানিনা আল্লা কবে নেবে।”
“ঘুমের ট্যাবলেট তো খেতে পারো।” আমি কিছু গায়ে না মেখে প্রস্তাব দিলাম।
“ধুস! আমাদের আবার ঘুমের বড়ি!জ্বরের বড়িই যোগাড় করতে কালঘাম ছোটে, আবার ঘুমের বড়ি!হুস !” মুখে একরাশ বিরক্ত নিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে আজাদ ভাই আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো!
আমি কথা না পেয়ে এদিক ওদিক দেখছি।দু জনেই কিছুক্ষণ চুপ।
বিরাট পাকুড় গাছের তলে বাঁশের মাচা। খালি গায়ে গ্রামের মানুষ, মুনিষ এই মাচাই সুযোগ পেলেই একটু জিরিয়ে নেয়।নগ্ন শরীরের ঘন ঘন আলিঙ্গনে মাচার গা একেবারে তেল তেলে। মাছি বসলে পিছলে পড়ার উপক্রম।বেলা বেশি হয় নি। পাকুড়গাছতলা পাড়ার মরূদ্যান। ক্লান্ত কৃষক এর তলে বসে তার ক্লান্তি ভোলে। গাছের ’পরে হাজার পাখির কলতান। পাশে শান্ত দিঘির গা হিম করা ফুরফুরে বাতাস। কচিকাচাদের হৈ হুল্লোড়। আর পাড়ার মা বোনেদের লাগামহীন পরনিন্দা পরহিংসার এ এক আনন্দঘন চর্চাকেন্দ্র।
“আব্বা বাড়ি যাও, মকছেদ এসেছে বাঁশ কিনতে।” হ্যাবল বলতে বলতে মাঠের দিকে দ্রুত পায়ে চলে গেল।মাঠের শেষে মরা নদিতে নেপাল কাকার পাটের জাগ আছে, সে পাট ছাড়ানোর মুনিষের কাজ করছে কদিন ।তাই এত তাড়া। দিনের শেষে দু পয়সা ঘরে আসবে। বসে থাকলে কি আর চলে। এমনি গ্রামে সেরকম কাজ নেই।ছেলে পিলে সব বাইরে। বেশিরদিন মুনিশের কাজও জোটে না। এদিকে মুদির দোকানে দিনের পর দিন তেল নুনের পয়সা ধার। গোপাল বেনি দেখা হলেই খ্যাচ খ্যাচ করে।
আজাদ ভাই দু হাঁটুতে খুব কষ্টে ভর দিয়ে মুখে বেশ লম্বা আ শব্দ করে, খাড়া হোলো। শুষ্ক দু হাতে মুখের ত্বক ঘষে বললে, “আসিরে ভাই। বেশ বেলা হয়েছে। দেখি মকছেদ আবার কি ধান্দায় বাড়িতে হানা দিয়েছে। শ্যালার বেটা শ্যালা বহুত পাঁজি। এক পয়সার মা বাপ। গতবার বাঁশ বেঁচে আমি ঠকেছি। এবার শ্যালা আবার কোন ফন্দি দেখাবে কে জানে!”
দিনকয়েক পরে আমি মরা নদীর তীরে ঘাসের ’পরে শুয়ে আছি আর মুক্ত আকাশের মেঘের পোলা পানদের খেলা দেখছি।সূর্য মাথার উপর। কিন্তু শীতের আভাসে সে অনেকটাই তেজ হারিয়েছে। আর নদীর ধারের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা আঁশটে বাতাস আমার চারিদিকে ভুর ভুর করছে। পাড়ার ছোড়ারা এখনও স্নানে আসেনি। গ্রামের মা বোনেরা শিয়ালের অত্যাচারে ঘাটে আসার সাহস পায় না। দিনে দুপুরে মানুষ কামড়াচ্ছে। পাশেই হালফিলের একটি বটগাছ।চাষিরা গাছের তলায় বসে নানা গল্প, বাক বিতণ্ডায় রত। মুখে সকলেরিই আগুন। দেদার বিড়ি ফুকছে।কেউ কেউ খুক খুক কাশছে।সবাই কতদিনের পরিচিত। তরুন না মরু না ক্ষেপা ঠিক সঠিক বুঝতে পারলাম না, বলছে, “এ ছোড়া আবার ঘাটের ধারে কি করছে?কবে বাড়ি আলো?” শুনে প্রত্যুতরে কেউ একজন বলে, “মুন্তাজ ভাইয়ের ছেলেটার মাঠের খুব নিশা। বাড়িতে আসা মাত্রই লুঙ্গি পরে মাঠে। আরে ও প্রফেছছার হয়ে কি সন্দর কথাবাত্রা!সকলের সাথে মেশে গো ছেল্ডা। না ওরা সব ভাইকটারই ব্যাবহার ভালো। আর ওই শ্যালা মাধাইয়ের ছেলে সন্দীপ, কি ধুনের কিসের পাশ কে জানে? দেমাক কত! মানুশকে মানুশ মনে করে না। করিস তো পরের বাড়িতে টিউশনি! ও একটি ছেলে? ধুশ। বাদ দেও ওর কথা!” এরকম কত কথা কানে আসছে। কত স্মৃতিরা দিনে রাতে ভিড় করে এখানে।এসব শুনতে শুনতে চোখটা কখন একটু এঁটে এসেছিল। হঠাৎ ডাকে ধুস মুশ করে উঠলাম।দেখি বটতলা ফাঁকা। আজাদ ভাই পাশে বসা।মুখে হাসির রেখা অস্পষ্ট। সূর্য অনেকটাই পশ্চিমে হেলেছে।গা কেমন শির শির করছে।
“আজাদ ভাই ভালই তো দান মারলে। মকছেদ একেবারে টাইট।” আমি হেসে বললাম।
“শ্যালা বড় পিছলা। ধরতে যাই অমনি পালায়। শেষমেশ ধরা বেটা পড়েছে। দাম দর একটা হয়েছে। কিন্তু বাইনা পত্তর কিছুই পাই নি। বোঝোনা দিন কাল কি সেই আগের মতো আছে।কথা পাল্টাতে কতক্ষণ? মানুষ তো খুব কম! সবই আমরা দু পেয়ে জীব। তাই…” আজাদ ভাইকে একটু চিন্তিত দেখায়।
“আজাদ ভাই অত ভাবলে কি চলে? সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, সেদিন সকালে অনেক কথা হলো। তোর সঙ্গে কথা বলে মনটা এখন অনেকটা হাল্কা।তবে আর একটি কথা সে দিন বলা হয় নি।কাউকে বলি নি আজও। আমার বলা নিষেধ। আর গ্রামের মানুষ তো আর সব ভালো নয়। এ ওর পেছনে কাঠি দিতে ওস্তাদ। তাই তোর সাথে দেখা হবার পর থেকে ভাবছি তোকে বলবো। আবার ভাবি আমাকে তো তোর ভাবি পৃথিবীর কাউকে বলতে বারন করেছে।কি যে করি? তা সে যাই হোক, তুই শহরে চাকরি করিস, তুই কি আমার ক্ষতি করবি?” আজাদ ভাই ঘাসের ’পরে থেবড়ে বসে একটি বিড়ি ধরিয়ে লম্বা দম মারলো। কপালে চিন্তার রেখাগুলির অবাধ আনাগোনা।মন অতীতের অন্ধকারে কি যেন হাতড়াচ্ছে।
“কি এমন কথা আজাদ ভাই যা তুমি বয়ে চলেছ?” আমি আগ্রহ ও অনাগ্রহের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“তোর ভাবি আমাকে আর বাঁচতে দেবে না। প্রায় রাতে দেখা দেয়। এটা বলে ওটা বলে। এমনকি আমাদের ছোঁয়াছুঁয়িও হয়।দ্যাখনা, আমার শরিল দিনের পর দিন শুকিয়ে একেবারে বাঁশের কঞ্ছি।” আমাকে হাত ধরে পরীক্ষা করতে পিড়াপিড়ি করতে থাকে।“আব্বা, মা মারা গেছে কতদিন কে জানে? কয় একদিনও তাঁদের দেখা পেলাম না। আর তোর ভাবি একদিন পর একদিন, কোন সপ্তাহে প্রতিদিন আমার পাশে বসে। সংসারের নানা কথা, ছেলে মেয়েদের, নাতি নাতনিদের খবর নেয়। মাথায় হাত বুলায়। পা হাত পা টিপে দেয়।” আজাদ ভাই এখন যেন একটি শিশু।মুখে সূর্যের রক্তিম তেরছা আলো পড়ায় কিরকম যেন অপার্থিব দেখায়! চোখ চিক চিক করে। কৃশকায় শরীরের জড়ো চামড়ায় বিকেলের পড়ন্ত রোদের ওম লাগে।আজাদ ভাই নিভিনো বিড়িতে আগুন লাগিয়ে দু এক বার ফুক ফুক করে দ্রুত টান মেরে সজোরে নিক্ষেপ করে।
“কখন আসে?”
“ঘড়ি তো কবে থেকে পড়ে মরচে ধরেছে।তা অনুমান দু টো আড়াই টা হবে।ঘুম তো আসে না রে ভাই। শুধু এপাশ আর ওপাশ। বারোটা একটা তো বাজে এই করে। কি করব? এ যে কি জ্বালা রে ভাই সে আমি বলে বুঝাতে পারব না।” একটু থেমে গামছাটিকে গলায় পেঁচিয়ে এক লাদা থুতু ফেলে গলা ঝাড়লো।
আমি গল্পের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখতে না হু হু না বলে মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে চলেছি।
“না, গত রাতে দেখা দেয়নি, তার আগের রাতের কথা।” আজাদ ভাই শুরু করলো।“ তোর ভাবি, তুই তো জানিস গত দশ বছর কি করে ওকে আমি টেনে নিয়ে বেড়িয়েছি। পাড়ার লোকও সব জানে।পায়খানা, প্রসাব, তেল মাখানো, স্নান করানো, কাপড় পাল্টে দেওয়া কি না করিনি।প্রথম দিকে তো এতো বেগ পেতে হয় নি। হাটতে পারতো না, ওইটুকু মাত্র। কিন্তু শেষের দু বছর হাতদুতটিও মুখের কাছে নিয়ে আস্তে পারতো না।প্রথম প্রথম চামচে করে একবার দু বার মুখে দিতে পারতো। কিন্তু আমি একদিনও ওকে কারোর ভরসায় রাখি নি।কেউ বলতে পারবে না। হ্যা, মাঠে গেছি, নদীতে গেছি। কাজ সেরে ছুটতে ছুটতে এসেছি। ছেলেরা, ছেলের বোউরা ঘুরিয়েও তাকায় নি।ভাই, ভিটে আর বাগান ওদের নামে লিখে দিতে হবে। আরে আমরা কি মরে গেছি না কি? রেজস্টরির পরে তুরা বাপ মাকে না দেখিস? আমরা পথে বসবো না কি? এই ভেবে ভাই আমি লিখে দেই নি। হ্যাবল আর সাত্তারের সেই থেকে কি রাগ। মাকে মা বলেই তো ডাকে না, মায়ের আবার তব্দির! হু!আমার সাথে ছেলেরা কথা বলে না। খোঁজখবর তো দুরেরে কথা। বৌমারা ডেকে দু বেলা দুটো খেতে দেয়। ঐ পর্যন্ত।কিন্তু হ্যাবলের ছোট মেয়েটা আমার খুব গা লাগা। আমার কোল ছাড়া থাকবেই না।গালে হা বুলানো, চুল ধরে টানা, চকলেট, বিস্কুটের বায়না সব আমার কাছে। এর জন্য হ্যাবলের বৌ আবার ওকে মারে। কিন্তু শিশু তো!একদিন দু দিন আসে না। তিন দিনের দিন যে কার তাই। আমিও ভাবছি মেয়েরা তো খোজ নেয় না। মরারা আগে হ্যাবলের মেয়েকে বাঁশ বাগানটি দিয়ে যাবো। এখন আল্লা ভরসা। সে এখন কখন নেয়। আমরা তো সামান্য মানুষ! আমাদের কি করার আছে?”
আজাদ ভাইয়ের মুখে ইতিমধ্যে কত ছবি ফুটে উঠলো।শত যন্ত্রণার ঘন কালো মেঘের মধ্যে বজ্রবিদ্যুতের কদাচিৎ আস্ফালন।
“জরিনা, মনু এরা দেখে না?”
খানিকক্ষণ মাথাটি মাটির দিকে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজাদ ভাই বলে, “দেখেনা বললে ভুল। দেখে!বড়টার বিয়ে হয়ছে ত্রিমোহিনী, আর মনুর হয়েছে আমতলায়। জামাইরা সব কেরল না বেঙ্গল থাকে।আর একাটা, কি যে দ্যাশটার নাম? হ্যা, গুজরাট ওখানেও ছিল কয়েকবছর।কিন্তু কি একটা গণ্ডগোলের পর থেকে জামাইরা আর ওখানে যায় না। আমিও নিষেধ করেছি। কি দরকার! টাকার থেকে জীবন বড়।গ্রামে গঞ্জে খাটো, শাক ভাত খাও। তাতেই সুখ। বিদেশ বিভুইয়ে থাকা। কখন কি হয় কে বলতে পারে। দ্যাশের অবস্থা তো ভালো নয়।মুছলমানদের তো মার ধোর দিছে যেখানে সেখানে।এই তো সব ফাল্গুন মাসে আসবে। ঘর দোর ঠিক করবে। বড় জামায়ের এক মেয়ে এক ছেলে, আর ছোট জামায়ের দুই ছেলে। বড়টা জায়গা কিনেছে ছয় লাখ তিরিশ হাজার দিয়ে। মোড়ের দিকে। আর ছোটো জামাই কিনেছে মধুপুর বাজারে আট লাখ এক চল্লিশ হাজার দিয়ে। এবার এসে নেন্টন ঢালায় দেবে বুলছে তো। ইট সব কিনা আছে। যা করে সব করুক। আমি আর কি করবো?”
বেলা পড়ে আসছে দ্রুত।অদূরে গাছের মাথাগুলিতে স্বচ্ছ কুয়াশার চাদর দিয়ে মোড়া। মরা নদির ছোট ছোট ঢেউগুলিতে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের সোনালি রোদ চুম্বনরত।বটগাছের মাথায় পাখির কলরব ক্রমশ বাড়ছে।সন্ধ্যা নামতেই হাজার বাদুড় ঝাঁকে ঝাঁকে এসে এই বিরাট গাছের ডালগুলিকে ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম। বাবলা গাছগুলিতে গন্ধহীন হলদে ফুল আলো করে ফুটে আছে।টলটলে নীল আকাশে ছোট ছোট বাহারি দুধ-সাদা মেঘের উদাসি সাঁতার।কলাবাগানগুলিকে দূর থেকে কেমন যেন ভূতুড়ে ঠেকে।মাঠে লোকজন কম।দুটি শিয়াল আমাদেরকে দেখে ধানের খেতে ঢুকে গেলো।
“আজাদ ভাই আজকে ওঠা যাক, মা চিন্তা করবে।আর একদিন তোমার কথা শুনবো।বেলা আর বেশি নেই।”
“মা দের কাজই তো চিন্তা করা।” গভীর শ্বাস নিয়ে গামছাটিকে গলা থেকে আলগা করে গায়ে জড়াতে জড়াতে সে খাড়া হল। আমি আর আজাদ ভাই এক সাথে মেঠো পথ ধরে সবুজ ধানের পাতার আলিঙ্গনের অতিরিক্ত স্নেহের অত্যাচার সহ্য করে হাত পা চিরে বাড়ি ফিরলাম।
পরের দিন সকালে আজাদ ভাই আমাকে ডেকে পাকুড় তলায় নিয়ে যায়। কি রকম যেন সে একটি নেশা পেয়েছে লোকটার। হয়তবা মনের কথা বলে আরও একটু হাল্কা হতে চায়। এমনি সব ফালতু কথা শোনার লোক খুব কম। আর যাদের সঙ্গে আজাদ্ ভায়ের উঠা বসা তারা সবাই একই গল্প শুনে শুনে ক্লান্ত। কেউ বলে নার্ভের ডাক্তার দেখাতে, আবার কেউ বলে পীর, সাধু বা ওঝার শরণাপন্ন হতে। আজাদ ভায়ের কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। আজ না কাল করতে করতে বেলা একেবারে শেষের দিকে।
“আরে কালকে ঘাটের ধারে অনেক কথা হলো। এত কথার মধ্যে আসল কথাটি বাদ পড়ে গেছে। অত কি আর মনে থাকে। বয়স হয়েছে। সব যেন কেমন এলোমেলো ঠেকছে। যাক, থাক ওসব কথা। এখন আসল কথায় আসি।”
“আসল নকল ওসব আমি মানি না। কথা তো কথা। যা হোক একটু ঝেড়ে কাশো সকাল সকাল।”
আজাদ ভাই শুরু করে। কিন্তু কথার মধ্যে কোন তেজ নেই। সেই নির্লিপ্ত অবয়ব, চোখে মুখে কোন উত্তেজনার ছাপ নেই। আগামি দিনের ভাল মন্দ স্বপন নেই। দিন যায় রাতে আসে, রাতের পরে আবার দিন। শুধু অলস সময়ের নিষ্ঠুর বেহায়া ভালবাসা। পোশাক বলতে সেই এক লুঙ্গি আর গেঞ্জি।পায়ে হাওয়াই চপ্পল সময় সময়।
“আগের দিন রাতে তোর ভাবি এসেছিলো। ঠিক আছে, আসবি আই, তুই একা আয়। ছেলেদুটিকে কেন নিয়ে আসিস? যখনই আসবে ঐ ছেলেদুটিকে নিয়ে আসে। ভাই, আমি তো খুব পরিশানির মধ্যে আছি। আবার করেছি কি জানিস, শুনলে তোর গায়ে কাটা দেবে। দেখি, ও তুই তো চিনিস, যেখানে রান্নাঘরের চালা ছিলনা, সেখানে একটি গভীর খাদ। আর ও ছেলেদুটিকে নিয়ে, বয়স বেশি নয়, সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, একেবারে সেই খাদের ধারে বসে আছে। পা দুটি সটান সামনের দিকে মাটির সাথে লেপ্টে। বাচ্চাদুটিকে পায়ের ’পরে রেখে সরষে তেল মালিশ করছে। ঠিক আছে। ওর হাতে তেল, বাচ্চাগুলি তেলে একেবারে চপ চপ করছে। একটু পেছল খেলেই তো সর্বনাশ। আমি তো দেখি মুশকিল।আমি বলছি একটু সরে যেতে, সে কোন আমার কথায় কান দিচ্ছে না। বাচ্চাদের কি সব হিজিবিজি বলে কপালে একবার গালে একবার চুমু খাচ্ছে, আর সময় সময় আমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হাসছে। বলতো ভাই কার না ভয় লাগে। আমি বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে একহাত মতো বাঁশের লাঠি, আমাকে হাত মেপে আজাদ ভাই দেখাল লাঠির দৈর্ঘ, মারতে যায় আর কি, কিন্তু মারিনি। কি করে মারি বল? সারাটা জীবন, তোরা তো সব দেখেছিস, কি না করেছি ওর জন্য!মেলা দেখানো, সার্কাস, বুলান গান, চড়কের মেলা, যেখানে বলেছে, আমি নিয়ে গেছি। তার মনের যত খায়িস আমি সবই পূরণ করেছি।এ জন্য তোর মা আমাকে ঠাট্টা করে বৌ পাগলা নাম রেখেছিল। আজ আর নেই,কিন্তু প্রতি মুহূর্তে ওর কথা আমার মনে পড়ে। আমার সাথ ছাড়া হতেই চায় না। এত চেষ্টা করি ভুলতে। কিন্তু কই পারলাম।” এক নাগাড়ে আজাদ ভাই বলে চলে। কোন চড়াই উতরাই নেই, কোন আবেগ নেই, কোন শারীরিক প্রতিক্রিয়া নেই। কথার মধ্যে কোন আঠা নেই। মানুষ কি এরকমও হয়!জীবনের প্রতি এত উদাসিনতা, এত নিঃস্পৃহতা, এত সাবলীলতা, এত উদ্বেগহীন এত নিরুত্তাপ। ভয় ও সমীহ ভেতরে দানা বাধে।
“মারতে গেলে তারপর?”
“ও। আমার আবার ওই একটা বদ অভ্যাস। এক কথা বলতে গিয়ে অন্য কথায় চলে যাই। এ নিয়ে লোকে বিরক্তও হয়। আসলে ব্যাপারটি কাউকে বলে আমি আজ পর্যন্ত বোঝাতে পারি নি।কথা বলতে চাই একটি। কিন্তু কি হয় কে জানে, বলার সময় হাজারটি আমার মুখ দিয়ে বেরুতে চাই।এ ওর সঙ্গে মার পিঠ শুরু করে। যে জেতে সে মুখ দিয়ে গোতাগুতি করে কোনরকমে বাইরে আসে। যাক ওসব সব বাদ। হ্যা, তুই কি বলছিলি?”এই বলে আগাদ ভাই আমার দিকে তাকায়।
চোখের মণিদুটি খুব বেশি ঘোলাটে। হাত মুখ পাংশুটে। আজাদ ভাই সুপুরুষ ছিল।অভাব, বয়স ও ভাবির বিয়োগে এখন শুধু আগের খোলস মাত্র।
“তুমি হাতে লাঠি তুলে…”
“থাক, থাক।লাঠি তুলে মারতে গেলাম কিন্তু মারতে পারলাম না। তারপর আবার কী? ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আর ঘুম আসে না। খানিক এপাশ ওপাশ করি। পিঠ ব্যাথা হলে উঠে কাঁথার এক কোনে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকি। এটা ভাবি, ওটা ভাবি। মাথা ঘুরপাখ খায়। আবার একটু গড়াগড়ি দিতে চেষ্টা করি। উঁ, হয় না। আবার উঠি।এই করে মোরগ ডাকলে উঠান দিয়ে সোজা বাগানের দিকে যায়। সুদিরদাশের আমবাগান। মানুষ দিনেও যেতে ভয় পায় সেখানে।”
এর মধ্যে হঠাৎ করে একজন বয়স্ক লোক আজাদ ভাই এর হাত চেপে ধরে নিয়ে পাকুড়তলার এক পাশে নিয়ে গিয়ে কি সব ফিস ফিস করতে থাকে।
পরে জেনেছি উনি জমিরুদ্দিন।বেশ লম্বা। গায়ের রঙ ফর্সা। এখন কোমর পড়ে গেছে। ফলে কুঁজো হয়ে মাঠঘাট দেখাশোনা করে। মাঠে যাওয়ার মুখে আজাদ ভাইকে পেয়ে খপ করে ধরে মনের জ্বালা নিভানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। লোকটির বুড়ো বয়সে বউ মারা যায়। ছেলেরা আলাদা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ভাত রাধবে কে? তাই সে আবার দ্বিতীয় বিয়ে করে। মেয়েটি জমিরুদ্দিনের হাঁটুর বয়সের। কিছুদিন ঘর করার পর নতুন বউ দিল্লী পালায়।যেটুকু জমি ছিলি বেশিরভাগ ছেলেদের বিলি করেছে।বয়স হলেও শরীর ছিপছিপের কারনে চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। শুধু কোমর সোজা হয় না।
(প্রথম প্রকাশ ‘রবিবার পত্রিকা’, মার্চ ২০১৯)