Bihyatjoner Upakhyan

বিহতজনের উপাখ্যান

গল্প –

কুরমি

‘বাবু, হাজার টাকা।’ ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে চায় কুরমি।মুখ মলিন, শরীর ছাই মাখা।    

এত সকালে দরজার সামনে কুরমি কে দেখে মিঃ সেন বেশ বিরক্ত। তবুও কাজের মেয়ে।এই লকডাউনে এসেছে যখন, নিশ্চয় কিছু বিপদে পড়েছে। তাই মুখে বিরক্তির মেঘ সরিয়ে সূর্যের ঈষৎ আভা মেখে বলে, ‘লকডাউন  চলছে।ট্রেকার, ট্রেন বাস সব বন্ধ।তুই এত সকালে এলি কী করে?’     

মিঃ সেনের জিঞ্জাসার মধ্যে কোন আন্তরিকতা বা সহানুভূতি ছিল না। কিছু তো একটা বলতে হবে তাই সে এমনিই বলে। ফর্মালিটি। 

‘ট্রেকারে বাবু। ছাগল ভর্তি ট্রেকার।প্রতি রোববার আমাদের মুন্ডাপাড়া থেকে একটা লাল ট্রেকার  আসে আপনাদের শহরে, বাবু। সামনের ছিটে জায়গা পাই নি। তাই ছাগলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে  আসতে পা ধরে গেল। একটু পা রাখার জায়গা ছিল না, বাবু। খাসি, পাঁঠাগুলি থরে থরে সাজানো। ব্যা ভ্যা কিচ্ছু নায়। মনমরা ভাষাহীন চোখ।আর চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হয়তোবা ওরা জেনে গেছে ওরা শেষের পথের যাত্রী।’        

মিঃ সেন কাপড়ের দোকানদার।পয়সা ফেলে পয়সা তোলে।সে শুধু ‘ট্রেকারে বাবু’ কথাটি শুনেই ব্রাশে পেস্ট লাগাতে গেল।বাকি কথাগুলি ভ্যাপসা গরমের উগ্র গন্ধে খানিকক্ষণ সেনবাবুর দরজার বাইরের বর্গাকার এক চিলতে ফালিতে ঘুরপাক খেয়ে শেষে কর্পূরের ন্যায় উবে গেল মহাকাশে।    

কুরমি গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কপালে বিন্ধু বিন্ধু ঘামের ফোঁটা। এই একমাস বাড়িতে বসে বসে খেয়ে পাঁজরার হাড়গুলি ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে। চোখদুটি কোঠরগত। গায়ের কালো রঙে আর এক পুর আলকাতরার প্রলেপ সদ্য লেগেছে।হাত পা নিস্তেজ অসাড়।মাইদুটি লেতিয়ে বুকের চামড়ার সাথে লেপ্টে আছে।             

মিসেস সেন এসির বাতাস বেশি ঠাণ্ডা হওয়াতে ঘুমের ঘোরেই বলে, ‘এই শুনছ।ফ্যানটা একটু কমিয়ে দাও না। বড্ড শীত শীত করছে।সোনামণির ঠাণ্ডা লেগে যাবে। কোথাই গেলে।তাড়াতাড়ি এ…এ স।’  বলেই মিনিট খানেক এপাশ ওপাশ করে, দু একবার সজোরে হাইতুলে আবার নিদ্রা গেল।

সকাল নটা।জেলখানার লম্বা সাইরেন জানান দিল। কুরমির বুকটা ধড়াশ করে উঠল। একদিন তার কাজে যোগ দিতে এই সাইরেন বেজেছিল।সেদিন তাকে ম্যাডাম দূর দূর করে রাস্তার কুকুরের মতো  তাড়িয়ে দিয়েছিল। কুরমির মনে খুব আঘাত লেগেছিল। কাজ এ বাড়িতে তার প্রথম নয়। আরও দুটি বাড়িতে করেছে। কেউ কোনদিন মুখের উপর কথা বলতে পারেনি। সময় সম্পর্কে খুব সে সচেতন। দূরের রাস্তা। মাঝ রাস্তায় দুর্ঘটনা। চোখের সামনে দুটি তরতাজা জীবন চলে গেল। রক্ত ফিনকি দিয়ে এসে কুরমির চোখেমুখে ছিটেফোঁটা পড়েছিল। ম্যাডাম বিশ্বাস করেনি।‘নিচু জাতের ছলের অভাব হয় না।’ কথাটি আজও বুকে বাজে। ‘পেটের তাগিদে কাজ করে খাই। মানসম্মান তো   বন্ধক দিই নি।’ ভেবেছিল মুখের উপর স্পষ্ট জবাব দেবে। কিন্তু কি মনে করে কুরমি ব্যথার  আঘাত  সয়ে মুখ বন্ধ করে  মাটির দিকে তাকিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। বাড়ি তো  নয়। একটা চালা। মা অন্ধ। ভাই একটা আছে। পাগল। কুরমি তাকে দড়ি দিয়ে ঘরের কোনের খুঁটিতে বেঁধে রেখে কাজে আসে। আবার দিনের শেষে বাড়ি পৌঁছে খুলে দেয়। একবার সে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে ছিল।সে কী হয়রান!  অনেক খোঁজাখুঁজির পর পঞ্চায়েত ডেকরা হেমব্রমের পুকুরপাড় থেকে নিয়ে আসে। পড়ন্ত সোনালি রোদ গায়ে মেখে একমনে সে মাছেদের দলে দলে সাঁতারকাটা দেখছিল একাকি একমনে। আর সে কী হাসির হিল্লোল! কী চেহারার জেল্লা! তার ভাই হাসতে জানে? সেই প্রথম কুরমির উপলব্ধি  হয়েছিল।     

আধঘন্টার বেশি কুরমি গ্রিলের সাথে লেতিয়ে দাঁড়িয়ে। আর পা পারছে না। হাঁটু কন কন করছে। বেল বাঁজাতে গিয়ে হাত কাঁপে বার বার।

‘মুখে মাস্ক কই? আর গ্রিলে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে! হা ভগবান! কার মুখ দেখে ঘুম ভাঙল? সর সর, দূরে দূরে আরও দূরে। বাড়িতে ছোট বেবি। আর তুই…। ওগো শুনছো। একবালতি ডেটল-জল। কুইক।’ বাড়ির গিন্নি বলে।   

‘কেন কী হল?’   

‘ন্যাকামি না করে যা বলছি শোন। যতসব পাগলের কারবার। ঘুম থেকে উঠেই টাকা। টাকার কি গাছ আছে না কিরে? নাড়া দিলেই পড়বে।’  

‘ম্যাডাম, ভাইটার আবার বাড়াবাড়ি হয়েছে।রাতদিন চিৎকার, গালিগালাজ, লাফালাফি করছে। একমাস কাজ বন্ধ।ওষুধ শেষ।একদিনও আমি অগ্রিম পয়সা চাই নি। কাজে নিলেই আমি দিনে দিনে শোধ করে দেব। আপনারাই তো মালিক। দুর্দিনে আপনারা মুখ ফেরালে আমি কোথায় যাব? তিনটি পেট।বসে বসে কতদিন চলবে?’ চোখ ছল ছল করছে কুরমির। গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঝিন ঝিন করছে।

‘শরীরটা যেন শত্রুতা শুরু করেছে। আগে দিনরাত এক করে দিয়েছি। কিছু বুঝতেই পারিনি। এখন সামান্য কাজেই  কেমন যেন বুক ধড়ফড় করে। গলা শুকিয়ে যায়। চোখ ফেটে বেরোয়।’কুরমি নিজের মনে বিড়বিড় করে।   

‘বললেই হলো । আমরা খবর দেখি না? সরকার চাল ডাল আলু তেল সব দিচ্ছে। কিসের অভাব? বাড়িয়ে বলতে বলতে তোদের জিভ বড্ড বেড়ে গেছে!তোর দাদার দোকান বন্ধ।অত টাকা কোথায় পাব? আমাদেরও তো চলতে হবে।এই রাখ দুশো টাকা।’ ম্যাডাম একটি নেতানো দুশো টাকার নোট ছুঁড়ে দিল দরজার বাইরে। ওটি গিয়ে পড়ল কুরমির পায়ের নিকটে। কুরমি শরীরটিকে দুমড়ে আস্তে  আস্তে নোটটিতে ফুঁ দিয়ে নোংরা রং চটা শাড়ির আঁচলে বাঁধলে।

মনে মনে ভাবলে বাড়ি ফিরে ভাল করে সাবান দিয়ে গা ধুয়ে চুল বেঁধে জোর করে চোখে আগুনের ফুল্কি তুলে হারুর দোকানের পয়লা বৈশাখের হালখাতা সারবে। দুশো টাকা হাতে পেলে নিশ্চয় বাকি ধারের জন্য হারু খেঁখিঁয়ে উঠবে না। জর্দা খাওয়া লাল জিভটা হয়তো লকলক করবে আর তাকে গিলে খাবে।এটুকু সহ্য না করলে বছরভর ধার হারু দেবে কেনে? এ রেখাতে কথা ফেলতেই চাপচাপ অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়।পরে চাঁদ ওঠে থমথমে আকাশে—ধূসর, ম্লান, নিষ্প্রভ।