দরবেশ তফিয়ত(রহঃ) ও তাঁর উরস

 

দেখ আমি নিজের স্বরূপ জানিনা। আমি খৃষ্টাণ ধর্মাবলম্বী নই, ইসলাম ধর্মাবলম্বীও নই,  ইহুদিও নই। পূর্ব পশ্চিম জলস্থল কোন স্থানেরই আমি অধিবাসী নই, ফেরাস্তা বা  শয়তান কাহারও সহিত আমার আত্মীয়তা নাই, আগুণ বা ফেনা কিছু হতেই আমি       উৎপন্ন নই, আমি সুদূর চীন,সারাসিন, বুলগার, পঞ্চনদী সমন্বিত ভারত, ইরাক,  খোরসান কোন স্থানেই আমি জন্ম নেই নাই। আমি ইডেন উদ্যান ও স্বর্গ হইতে পতিত  হই নাই, আমি আদমের বংশধর নই। সমস্ত স্থানের উর্দ্ধে চিনহ ও উদ্দেশ্য বিহিন দেশে     দেহ ও আত্মাকে অতিক্রম করিয়া আমি আমার বন্ধুর বুকে চিরনবীন বেশে বাস করি।

——- জালালুদ্দিন রুমি

উত্তরবঙ্গের মুসলিম সমাজের জনগোষ্ঠীগুলির বেশিরভাগই ধর্মান্তরিত। হয় পীর ও দরবেশ দ্বারা অথবা মুসলিম শাসকদের সংস্পর্শে এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। উত্তরবঙ্গে সুফি দরবেশদের স্বর্ণযুগ ছিল ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতক।এই পীর দরবেশদের জীবন কাহিনী যেটুকু এদিক ওদিক থেকে পাওয়া যায় এবং যা অতিরঞ্জিত আকারে লোকমুখে প্রচারিত হয়, তা থেকে অনুমান করা যায় এরা সবরকম ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার বাইরে ছিলেন। ইসলামের নিয়মনীতির পরিবর্তে এরা এই ধর্মের উদার, শান্তির, মানবতার দিকগুলির প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন। এবং তারা এই সুকুমার গুণাবলীর পথপ্রদর্শক হিসেবে সাধারণ মানুষের সামনে ইসলামকে তুলে ধরতেন।ছিল না নিয়মিত নামাজ পড়ার প্রচলন। হাদিস ও শরিয়তের অনুশাসন ছিল শিথিল। বছরের নির্দিষ্ট দিনে পীরের দরগায় ধূপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ‘আল্লাহ’ বলে জিকির (জপ) করার রীতি চালু ছিল। আর ব্যাবহারিক জীবনের বিশ্বাস, আচরণ, পেশা, ভাষা, ইত্যাদি সবই চলত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে তালমিলিয়ে।

সেই থেকে আজ পর্যন্ত স্থানীয় মুসলিম সমাজ উত্তরাধিকার সূত্রেই অনুসরণ করে চলেছে। পরবর্তী কালে  হাদিস শরিয়তের চাপেও এই লৌকিক জীবনের সংস্কৃতিতে কোনরকম ব্যাপক ছেদ পড়েনি।এখানে তাদের উৎসগত পরিচয়ও ধরা পড়ে। আজ শিক্ষা, পেশাগত পরিবর্তন, হাদিস শরিয়তের ক্রমবর্ধমান চাপ, নিত্য নতুন জীবন সংগ্রাম এই গ্রামীণ জীবনের অনেক পরিবর্তন ঘটালেও, লোকাচারগুলির বিলুপ্তি ঘটেনি। এই লোকাচারগুলির মধ্যে কয়েকটির নাম করা  হয়তবা অমূলক হবে না। সেগুলি হলো—গোচল পানা, নয়াভাত বা নবান, পুষনা, বাঁশ খাঁড়া, বড়ঘর, হলুদমাখা,চাইলন বাতি, মানত, মাগন, ইত্যাদির সাথে সাথে উরস উৎসবও। এই লোকাচারগুলি প্রমাণ করে এখানকার মুসলিম সমাজ ইসলামী করণের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে ইসলামকেই লোক-কোরণ করেছে।[1]ইসলামের বিশুদ্ধতার শুভ্রতা অনেকটাই ফিকে হলেও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ছে এই লৌকিক উপাদানগুলির মিশ্রণের ফলে। একথা স্বীকার করতেই হয়।

পীর কথার অর্থ ‘প্রাচীন’। পীরের আর একটি সোজা অর্থ  আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক, গাইড ও শিক্ষক। তিনি তাঁর অনুগামীদের ইসলামের উদারতা ও মরমীবাদ তুলে ধরে ঈশ্বরের পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। লোকে বিশ্বাস করে যে পীরের সাথে ঈশ্বরের যোগাযোগ আছে।তাই সহজ কথায় পীর বা দরবেশ ঈশ্বরের কাছে পৌছানোর একটি সিঁড়ি বা মাধ্যম। পীর সম্পর্কে কবিগুরু লিখেছেন,

“তুমি কাহার সন্ধাণে

সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে।

তোমার ভাবনা কিছু নাই,

কে যে তোমার সাথের সাথী

ভাবী মনে তাই।”

(গীতাঞ্জলিঃ৫১)

মধ্যযুগীয় ভারতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনার যে সকল দৃষ্টান্ত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন উদ্ধৃত করিয়াছেন তন্মধ্যে পীর পূজা অন্যতম। ভারতীয় মুসলমান সমাজের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ইহা এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য  ও বঙ্গদেশে প্রচলিত লোক প্রিয় ইসলামের সর্বাপেক্ষা মহত্ত্বপূর্ণ উদাহরণ। প্রতি শহর বা গ্রামে পীরের পূজার প্রচলন ছিল।[2]

বিশিষ্ট সুফি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শা নুরউর রহমান লিখেছেন,

The belief in pirs and worship at their shrines did not originate in India but  were brought from Afghanistan, Persia and Iraq by the immigrants, along  with their religious orders. But in India in general and Bengal in particular,  certain factors facilitated the penetration of the saint worship into Muslim  society. Pir worship was a form of joint worship of the Hindus and the Muslims in medieval Bengal. The large settlement of foreign Muslims side  by side with the Hindus and the converts enabled Islam to strike its root deep in society. The worship of local gods and goddesses largely contributed to  it.[3]

প্রাচীনকালে মুসলমান সেনাপতিগণও যুদ্ধে নিহত হলে গাজী পীর নামে পূজিত হতেন। ধীরে ধীরে এ সকল পীর স্থানের মাহাত্ম্য হিন্দু জনসাধরনের মধ্যেও প্রচলিত হল। ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল প্রভৃতি কাব্যে  রচিত দিগ-বন্দনায় বাংলার পুরাতন পীর ও পীরস্থানের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ হিন্দু লৌকিক সাহিত্যকারগণ মুসলমান পীর ও সে সব দরগাগুলিকে মঙ্গলকাব্যেও স্থান দিয়েছেন। ইহা কি হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ের এক অকাট্য নিদর্শন নয়? যে সকল ঐতিহাসিকগণ কেবলমাত্র অতিরঞ্জিত ইসলাম গৌরব-মন্ডিত কাহিনীর যথার্থ পরীক্ষা না করে  বা আইনগত সিদ্ধান্ত বাস্তবিক ক্ষেত্রে কাজে পরিণত হয়েছিল কিনা বিচার না করে এই যুগে নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার ও অসহিষ্ণুতার  চিত্র অঙ্কন করেছেন তাঁহাদের অভিমত অন্ততঃ আংশিকভাবে ভ্রমাত্মক

সাধারন মানুষ বিশ্বাস করত যে সুফি ও পীরেরা  অলৌকিক শক্তির অধিকারী। ভারতীয় তথা বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে এই বিশ্বাস বরাবরই ব্যাপক ছিল। তারা পীরেদের সাহায্য ও অনুগ্রহ কামনা করত এবং তাঁদের প্রদত্ত কবচ ও মাদুলীর সাহায্যে বিপদ এড়াবার প্রয়াস করত। হিন্দু ও মুসলমান  উভয় সম্প্রদায় এসব অলৌকিক শক্তিতে গভীর বিশ্বাস রাখত। তারা মৃত পীরের  আত্মার প্রতি নৈবদ্য ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতেন। মুসলমান জনসাধারণ অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির চাইতে সন্তপীর গণের পূজাতেই বেশি আকর্ষণ বোধ করত।  যার ফলে ধীরে ধীরে পীরেদের দরগাগুলি জনপ্রিয় তীর্থস্থানের মর্যাদা লাভ করে। এই দরগাগুলিতে হিন্দু ও মুসলমান সবাই একাকার হয়ে গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করত। মসজিদের থেকে পীরেদের সমাধিস্থলে অনেক সময় বেশি জনসমাগম হত।আর দরগাগুলি দেখ ভাল করার জন্য স্থানীয়  অভিজাতেরা বিশেষ যত্ন নিত।তাঁরা এটিকে মহৎ কাজ বলে মনে করত। হিন্দু প্রথার অনুকরণে বিভিন্ন আকারের দন্ড বা বল্লমে প্রতীক হিসেবে পতাকা লাগিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে ভক্তবৃন্দ দরগায় আসত, প্রার্থনা করত, ও নৈবদ্য প্রদান করত। হিন্দুদের তীর্থস্থানগুলির ন্যায়  দরগায় অনুষ্ঠিত উরস মোবারকে বিভিন্ন শ্রেনীর লোকের সমাগম হত। প্রকৃত ভক্তরা ছাড়াও  গায়ক, বাদক, যাদুকর,  বাইজী, নিষ্কর্মা, চরিত্রহীন, ধূর্ত ও প্রতারকেরাও ভিড় করত। এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও  কোন ইচ্ছা পূরণের অভিলাষে, অথবা পার্থিব সুখের কামনায় যথা পুত্র লাভ, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, ভাগ্যের পরিবর্তন, কিম্বা উচ্চপদের আকাঙ্ক্ষায়। আর জীবিত পীরের সাথে মুসলমান ভক্তের শ্রদ্ধার  সাথে গুরু ও গোঁসাইয়ের প্রতি হিন্দু শিষ্যের ভক্তি প্রদর্শনের মিল লক্ষ্য করা যায়।[4]

দরবেশ বা পীরদের সাথে মোল্লাদের একটি পার্থক্য খুব মোটা করে বিদ্যমান। মোল্লারা মুসলমানদের স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত, যেখানে সুফি বা দরবেশদের মুক্ত মন, ভক্তি ও ভালোবাসার রাস্তায় ঈশ্বর কে পাওয়ার উপর জোর দিয়েছেন। লক্ষ্য এক হলেও পথ ভিন্ন।সুফিবাদের উদারতা ও সর্বমানবপ্রেম বহু মানুষের মন জয় করে ইসলামের প্রচার, প্রসার, ও তাকে স্থায়ী রুপ দিতে সাহায্য করেছে। আর ভারতীয় মুসলমানরা সুফিবাদের মাধ্যমে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও খৃষ্টানদের অহিংসা ও শান্তিবাদকে গ্রহণ করেছিলেন। সুফিরা বেদান্তিকদের মত জোরের সাথে বিশ্বাস করতেন যে সবই ঈশ্বর এবং ঈশ্বরই সব।

সুফীদের ‘পীর-মুরীদি’ সম্পর্ক হিন্দুদের ‘গুরু-চেলা’ সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত। ঈশ্বর অন্বেষণে একজন মুরীদের কাছে তাঁর পীরের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকে একজন হিন্দু শিষ্যের কাছে  তাঁর গুরুত্ব ঠিক ততধিক। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের একজন পীর থাকতেন। এসব পীরেরা কোন ন কোন সু্ফী গোত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমানের কাছে পীরেরা খুবই সমাদৃত ছিলেন। সেই জন্য সমকালীন একজন বাঙালী কবির মুখে শুনতে পাই,

“হিন্দুর দেবতা হইল মুসলমানের পীর

দুই কুলে লয় পূজা হইয়া জাহির।”

সুতরাং পীর দরবেশদের মরমীবাদ শরীয়তের কঠিন বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে এবং মধ্যযুগের ভারতবর্ষে এক নতুন ও উদার মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছে, এবং ভালবাসার মন্ত্রে মানুষকে জয় করেছে। ইসলামি মরমীবাদ স্বক্ষমতায় সর্বব্যাপী ও সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। তাই পীর ও দরবেশরা তাদের উদার ও সহজিয়া মরমীবাদের মাধ্যমে ভারতবর্ষের চিরায়ত বহুত্ববাদীর সাংস্কৃতিক ফল্গুধারাকে আরও সঞ্জীবিত করেন। এবং এই সঞ্জীবনী ধারা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু ভাষার বহু জাতীর, বহু ধর্মের  বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের মননে একতার মেলবন্ধনের মালা গাঁথতে সমর্থ হয়েছে। আর মনে হয় এখানেই পীর ও দরবেশদের সমাধিকে ঘিরে উরস মোবারক ধূমধামের সঙ্গে পালনের সার্থকতা ও উপযোগিতা নিহত রয়েছে।

পীর বা দরবেশদের কাল্পনিক চরিত্র সম্পর্কে লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী ও উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রায় সর্বত্রই তাঁদের মৃত্যু দিনটিকে উরস উৎসব হিসেবে পালিত হয়।উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে বিভিন্ন পীর, দরবেশদের সমাধিস্থল ছড়িয়ে আছে। এদের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে ইসলাম ধীরে ধীরে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করে। ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত অসংখ্য পীর ফকির এই এলাকায় এসেছেন। তাদের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন লোককাহিনী, খানকা, চিল্লা বা ধাম পরিচিতির মাধ্যমে বেশ কয়েকজনের কথা মানুষের মধ্যে বহুল প্রচলিত এবং এদের ‘মাযার’গুলি বিশেষ করে উরস উৎসবের সময় উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতিতে এক বহুমাত্রিক দিক যোগ করে। উল্লেখযোগ্য পীরগুলির মধ্যে কয়েকজন নিম্নরূপঃ

১।মালদহের কালুয়াদীঘির কালুপীর

২।পুরাতন মালদহের তুতবাড়ির পীর শাহ মালদহ

৩।মালদহের কালিয়াচকের টাঁড়াঘাটিতে একদিল শাহ

৪। মালদহের চাঁচলের পিচকা শাহ

৫। পান্ডুয়ার কাজী পীর

৬। তোরষা পীরের ধাম কোচবিহারের হরিণচড়ায় তোরষা নদীর ধারে

৭। হলদিবাড়ির একরামুল হক, যিনি ‘হুজুর সাহেব’ নামে পরিচিত

৮। শাহ গরিব কামালের দরগা কোচবিহারের গোসানিমারিতে

৯। শিতলখুচীর পাগলা পীর

১০। উত্তরদিনাজপুরের পীর আব্দুল কাদের সাহেবের ‘দীপনগর মাযার’

১১। ডালখোলার  পীর রহমতুল্লাহের ‘জিয়াগাছি মাযার’

১২। জলপাইগুড়ির ‘কালু সাহেবের মাযার’

১৩।আলিপুরদুয়ারের রাঙালিবাজনার তফিয়ত সাহেব

এছাড়া জানা অজানা অনেক পীরের নাম নানা আখ্যানে ছড়িয়ে আছে—একিনপীর, তেতুরপীর, মানিকপীর, কাটাপীর, ইত্যাদি। এসব দরগায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ধূপ, মোমবাতি জ্বালায়, মাযারে চাদর চড়ায়।এমনকি  উরুসের আগে অনেক মাযার হিন্দু গোয়ালারা দুধ দিয়ে ধুয়ে দেন।

এখন আমরা তফিয়ত সাহেবের কথায় আসি। সে বহুদিন আগের কথা। আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট বীরপাড়া ব্লকের খয়েরবাড়ি ও ইসলামাবাদ গ্রামে দেখা যায় এক পাগলাটে মানুষকে।কথা কম বলতেন। অনেক সময় খাবার চেয়ে নিতেন। অনেক সময় খাবার দিলেও ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। অনেকে তাঁকে পাগল বলে এড়িয়ে জেতেন।অনেকে আবার তাঁকে মানতেন দরবেশ বা দেবতা হিসেবে। তাঁর অন্যতম প্রধান ভক্ত ছিলেন ব্রজমোহন লাখোটিয়া। এলাকার বিত্তশালী মানুষ হিসেবে তিনি দিনের পর দিন তফিয়ত সাহেবের সেবা করে নিজেকে ধন্য করেছেন। এছাড়া এই এলাকার বাসিন্দা আলিয়ার রহমানের বাড়ীতে দীর্ঘদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন তফিয়ত সাহেব।  কোনোদিন ধর্মের কথা বলেননি দরবেশ তফিয়ত সাহেব। কাউকে উপদেশ দেন নি।মোবারক।সতের বছর আগে তিনি প্রয়াত হন।  তাঁর প্রয়াণের পর গ্রামবাসীরা তাঁর সমাধি ঘিরে গড়ে তোলেন বিরাট সৌধ। প্রতি বছর ২৩ ও ২৪ মাঘ পালিত হয় তাঁর উরস মোবারক ও সম্প্রীতি মেলা। মঞ্চে মুসলিম মৌলানাদের সাথে গীতা পাঠ করে বক্তব্য রাখেন হিন্দু পণ্ডিতরা। অমল রায়চৌধুরীর মতো সুবক্তাকে দেখা যায় গীতার মন্ত্রের সাথে পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত পাঠ করে বক্তব্য রাখতে। অমলিন আলোয় উদ্ভাসিত সমাধি প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে হিন্দুরা হাতজোড় করে প্রার্থনা করেন। আর মুসলিমরা হাত তুলে দোয়া করেন।

হলদিবাড়ির হুজুর সাহেবের উরসের মত  বিপুল জনসমাগম এখানে হয়না ঠিকই। এবং হুজুর সাহেবের ন্যায় তফিয়ত সাহেবের মাহাত্ম্য দেশ ও বিদেশে প্রচার পায়নি। কিন্তু আয়োজনের দিক থেকে ছোট হলেও স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে উরস উৎসবের মাস খানেক আগে থেকেই নানা ব্যাস্ততা চোখে পড়ে। আর একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়। সেটি হল উরুসের দেওয়াল পোষ্টার। বাড়ি ইটের বা পাকাঠি বা বাঁশের দর্মার হোক, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় প্রতিটির গায়েই উরসের পোষ্টার সাঁটানো।এর থেকে কিছুটা অনুমান করা যায় উরসের ব্যপকতার প্রভাব সাধারণ জনমানুষের উপরে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের

মানুষের মধ্যে তফিয়ত সাহেবের নানা অলৌকিক শক্তির কাহিনী বয়স্ক মানুষের কাছ থেকে জানা যায়। গ্রামের একটি চায়ের দোকানে বসে মকবুল হক চায়ে সুড়ুক সুড়ুক চুমুক দিচ্ছে। কথায় কথায় পরিচয় হল। জানতে চাইলাম তফিয়ত সাহেবের কথা।

মকবুল সাহেব বললে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর’। পেশায় গাড়িচালক হলেও এলাকার সংস্কৃতির গলিপথে তার অবাধ বিস্তার। অনেক কথার মাঝে তার ব্যক্তি জীবনের কথাও উঠল। “স্যার, আমি ভ্যান চালাতাম। তফিয়ত সাহেবের কাছে হাত পাতি। দেখুন আজ আমি নিজের বোলেরো চালায়। আর একটি কথা। আমার ছ বছরের চ্যাংড়া কুকুরের কামড়ে ষাট দিনের পর মারা গেইল। বাড়ির মানুষ কি কান্নাকাটি! বাড়িতে মন টেকে না। একদিন এশার নামাজের পর মানত করলুং হুজুরের কাছে এই বলে, ‘আমার ঐ চ্যাংড়াই নাগবে।’ স্যার বিশ্বাস করবেন না, সাত মাসেই আমার চ্যাংড়া ঘরে আসিল। তা কি বলবেন? এই হল তফিয়ত সাহেবের হাত। আরে বোঝেন না ক্যান, উনার সাথে আল্লার সরাসরি কথা হয়।আমরা ডাকলে, হ্যাঁ, ডাকার মত ডাকলে, উনি হাজির হন। এই কালু কি?মুই মিছা কঙ? মিথ্যা কলে হুজুর ছাড়ং।কালু কিন্তু হিন্দু।সে সন্মতির মাথা নাড়ে।”

মকবুলের চোখ চিক চিক করে। লম্ফের আলোতে মুখের ছবি কিছুটা অস্পষ্ট। দেখে কি রকম মায়াবী মনে হয়। মকবুলকে হঠাৎ অচেনা লাগে। কিছুটা উদাস, কিছুটা দুর্বোধ্য!

এরকম অজস্র কাহিনী রাঙালিবাজনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কি হিন্দু কি মুসলমান, হাত তুললে তফিয়ত সাহেব হাত খালি ফেরান না। এলাকার মানুষ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় মুগ্ধ। পার্থিব জগতের চাওয়া পাওয়া থেকে অপার্থিব ইচ্ছে কিছুই অপূর্ণ থাকেনা বলে সাধারমানুষ বিশ্বাস করেন। আর এ বিশ্বাস এলাকার আপামর  মানুষের মজ্জাগত। জোর করে চাপানোর কিছু নয়। তাই এই বিশ্বাসের যাদুবলে হাজার হাজার মানুষ তাঁর উরস মোবারক মহানন্দে পালন করে। এ উরস যেন মহা মানবের মিলনক্ষেত্র।এখানে না আছে জাতিভেদ, না আছে কোন বিশুদ্ধ ইসলামের নিয়ম রীতির দৃঢ় ফাঁস। এক উদার মরমীবাদের মিলনমেলায় মানুষ আমার আমি কে খুঁজে পাই। তাই তো এত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস। তবিয়ত সাহেব যেন এক জীয়নকাঠি যার আলতো স্পর্শে মানুষের শত অব্যাক্ত ব্যাথা নিমেষে দূর হয়। মানুষ ভেদাভেদের কৃত্রিম প্রাচীর ভেঙ্গে একে অপরের সাথে মিলিত হতে উৎসুক হয়। আর এখানেই উরস মোবারকের সার্থকতা।

তফিয়ত সাহেব সম্পর্কে স্থানীয় কিছু গুণী জনের মন্তব্যঃ

১। “হিন্দু-মুসলিম  সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দরবেশ তফিয়ত (রহঃ)-এর উরস মোবারক।”

–   প্রদীপ সুত্রধর, প্রক্তন সদস্য, খয়েরবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত

২। “সম্প্রীতির সৌহার্দ্যের স্বারক দরবেশ তফিয়ত (রহঃ)-এর উরস মোবারক।”

-আশিস কুমার পঞ্চানন, প্রধান শিক্ষক রাঙগালিবাজনা মোহন সিং উচ্চ বিদ্যালয়

৩।“দরবেশ তফিয়ত (রহঃ)-এর উরস মোবারকে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকে না।”

– প্রদীপ বারা, শিক্ষক, হলেশ্বর হাইস্কুল ঘোকসাডাঙ্গা, কুচবিহার

৪। “জীবদ্দশায় দরবেশ তফিয়ত (রহঃ)যাকে যা বলেছেন, ফলে গেছে।প্রয়াণের পরও তাঁর দোয়া থেকে   বঞ্চিত নন কেউই।”

– মহম্মদ নূর আলম, সভাপতি, উরস মোবারক কমিটি

সাধারণভাবে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে আয়োজিত হয় উরস। হলদিবাড়ির হুজুর সাহেবের  উরস মোবারক পালিত হয় ৫ ও ৬ ই ফাল্গুন আর তফিয়তের উরস মোবারক পালিত হয় ২৩ ও ২৪ শে মাঘ। সমাধি প্রাঙ্গনে মোমবাতি ও ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন সকলে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা পীরপন্থায় বিশ্বাসী, তাঁরাই মোমবাতি জ্বালিয়ে জিয়ারত করেন। তবে বিশুদ্ধ ইসলাম সমাধি প্রাঙ্গনে মোমবাতি বা ধূপ জ্বালানোর অনুমতি দেয় কি না এ বিষয়ে মতভেদ বর্তমান।এখানে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ থাকেতেই পারে। আমি সেটাই না গিয়ে একথা বলতে পারি উত্তরবঙ্গে লৌকিক সাংস্কৃতিক জীবনে উরস মোবারকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে। কি হিন্দু, কি মুসলমান, সকলেই এই মিলন  উৎসবের দিনে একের সাথে অপরকে আপন করে নেয়। এ যেন হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সহমর্মিতার এক উদার আকাশ এবং যার পরম্পরা সেই কবেকার কে জানে!

উত্তরবঙ্গের নস্য শেখ হিসেবে যারা পরিচিত, সেই মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক অমুসলিম রীতি নীতির প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। যেমন উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ মুসলিমদের  বিয়ের অনুষ্ঠানে মহিলারা একত্রিত হয়ে সমস্বরে ‘গীত’ গেয়ে এক অপূর্ব আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করেন।বিয়ের হলুদ মাখানোর রীতি রেওয়াজেও দেখা যায় থালায় ধান, দূর্বা, পানপাতা ও মাতিত প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি দেওয়ার রীতি অনেকেই মানেন।উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম জনজাতি রাজবংশীদের আচার আচারণ ভীষণভাবে প্রভাবিত করে এখানকার নস্য সেখ মুসলিমদের সাংস্কৃতিক জীবনকে। তবে পীর বা দরবেশদের সমাধিস্থলে মোমবাতি ও ধূপ জ্বালানোর রীতি শুধু উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গ নয়, ভারতবর্ষের সবজায়গায় কম বেশি পরিলক্ষিত হয়। আজমীঢ় শরীফের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির  দরগা থেকে শুরু করে দিল্লীর নিজামুদ্দিন  আউলিয়া সব জায়গায় ছবি একই। এ দিক থেকে দেখলে অলি অউলাদের কবরে মোমবাতি ও ধূপ জ্বালানো একটি পীরপন্থিদের একটি চিরায়ত প্রথা।

সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের কথা ধরে নিলেও উরসে হিন্দু-মুসলিম একত্রে প্রার্থনার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি পার্থক্য দেখা যায়।উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই মোমবাতি, ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন। তবে অমুসলিমরা সমাধিস্থলে শায়িত পীর দরবেশদের উদ্দেশ্যে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেও, মুসলিমরা তা করেন না। ইসলাম ধর্মের নিয়ম মোতাবেক একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর দ্বিতীয় কাহারও উদ্দেশ্যে সেজদা করা নিষেধ।তাই মুসলিমদের অনেকেই সমাধিস্থলে গিয়ে পদচুম্বন করেন।

মূলতঃ উরস মোবারক উৎসবগুলি ভারতীয় সংস্কৃতির চিরাচরিত সম্প্রীতির মিলনের ধারাটিকেই তুলে ধরে। উরস এককথায় একটি মিলন মেলা। এখানে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই পায়ে পা ও হাতে হাত মিলিয়ে এক মহামানবের জনস্রোতে নিজেকে বিলীন করে দেয়। এ যেন কেমন মায়ার বন্ধন। বছরের আর পাঁচটা দিনের একঘেয়েমি ক্লান্তির মলিনিতা উরসের দিন দরবেশের অলৌকিক মহিমায় ফুঁৎকারে উবে যায়। মানুষগুলির কষ্টকর জীবনে ফুর বাতাস লাগে। হানিহানি, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, সন্দেহ, উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যেখানে গ্রাম ও শহরের বাতাসকে বিষাক্ত করতে বদ্ধপরিকর, সেখানে উরসের মিলন উৎসব কিছুটা হলেও অন্ধকার দূর করে আলোর জ্যোতি ছড়াতে সদাব্যাস্ত।

এই পীর সাহেবদের প্রভাব ও জনপ্রীয়তা আজও সমান তালে অটুট রয়েছে। বিশুদ্ধ ইসলামের নিয়মনীতির বন্ধন থেকে মুক্ত পীরমান্যতা অনেকের কাছে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করলেও বাংলার লৌকিক জীবনে পীরদেরকে কেন্দ করে যে উরস পালিত হয় তা ইসলামের মরমীবাদের একটি সুমহান ঐতিহ্যকেই সরল সাবলীল ভাবে তুলে ধরে অমুসলিমদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। হিন্দুরা এই উরুসে অংশ নিয়ে আমাদের চিরায়ত সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে সুদৃঢ় করেন। এতে মুসলমানদের বিশেষ করে আজকের দিনের ভারতবর্ষের তথা বাংলার মুসলমানদের যারা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা  নামক একটি বারুদের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের গর্বিত হওয়া উচিত। লৌকিক আচার আচরণ আমার মনে হয় ইসলামকে কলুষিত না করে ইসলামের শাশ্বত শান্তি ও সম্প্রীতির বাণীকেই তুলে ধরে এবং সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভেদাভেদের লক্ষ্মণরেখাকে টপকাতে সাহায্য করে। যার ফলে তৈরি হয় সম্প্রীতির বাতাবরণ এবং জীবন সাময়িকভাবে হলেও মুক্ত হয় সর্বগ্রাসী অবিশ্বাসের বিষাক্ত পরিমণ্ডল থেকে।আর রাঙালিবাজনা গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পিছনে দরবেশ তফিয়ত সাহেবের অবদান অগ্রাহ্য করা যায় না। এখানেই তফিয়ত সাহেব এবং তাঁর মত হাজার হাজার মাযারের সম্প্রীতির  উরস উৎসব বাংলার গদ্যময় লৌকিক জীবনে অন্য মায়াবী মাত্রা যোগ করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথকে উদার, সুপ্রসস্থ ও বন্ধুরহীন করে তুলতে আপোষহীন সংগ্রামে রত।

[1] বজলে রহমান, উত্তরবঙ্গের মুসলিম সমাজ, কোচবিহার, এস বি বুক ডিসট্রিবিউটরস, ২০০৮, পৃ. ৯৪।

[2] জগদীশনারায়ণ সরকার, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (মধ্যযুগ), কলকাতা, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, দ্বিতীয় সস্করণ, মাঘ ১৪২১, পৃ. ৬০।

[3] Shah Noorur Rahman, Hindu-Muslim Relations in Mughal Bengal, Kolkata: Progressive Publishers, 2001, pp. 53-54.

[4] জগদীশনারায়ণ সরকার, পৃ. ৬৩-৬৪।

Share This

Abu Siddik

Abu Siddik

It's all about the unsung , nameless men and women around us. I try to portray them through my tales. I praise their undying suffering and immaculate beauty. And their resilience to life's vicissitudes, oddities, and crudities I admire. They are my soulmates who inspire me to look beyond the visible, the known, the common facade of the educated and the intellectuals.

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Categories

Top Comments

Subhash Chandra
Read More
"A gifted writer"

A gifted versetile writer who writes excellent stories and poems on the invisibles, pariahs, margins, aged, weaklings of our society. A rising star on the literary firmament.
Santosh Bakaya
Read More
Praise for my writing

“Your story Undersell left me with a lump in my throat, so did your poem, He also lights candles.”
Louis Kasatkin
Read More
Praise for my poem "Elderly Men Two"

"A finely honed observational piece recording the minutiae of everyday life. Rendered with the author’s customary poetic aplomb suffused with a Borges like quality of the mythic."

So glad to see you here!

Want to be the first one to receive the new stuff?

Enter your email address below and we'll send you my writings straight to your inbox.

Thank You For Subscribing

This means the world to us!

Spamming is not included! Pinky promise.