খুব অল্প বয়স, মানে পাঁচ ছয় বছর থেকেই আমি জানতাম যে আমি লেখক হবো ।আর সতের থেকে চব্বিশ বছরের মধ্যে আমি আমার লেখক হওয়ার ধারণা ত্যাগ করলাম। যদিও আমি জানতাম যে আমি আমার সত্যিকারের স্বভাবকে আহত করলাম। এবং এও জানতাম যে দেরিতে বা তাড়াতাড়ি আমি স্থির হয়ে বই লিখব।
আমি বাবা মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে মধ্যস্থানে ছিলাম, এবং বড় ও ছোট উভয়ের থেকেই আমার বয়সের পাঁচ বছরের পার্থক্য ছিল।আমার বয়স আট বছর হওয়ার আগে আমি কদাচিৎ বাবাকে দেখেছিলাম। এজন্য ও আরও কিছু কারণে আমি একটু খাপছাড়া গোছের ছিলাম। যার ফলে স্কুলের জীবনে আমি অনেকের অপছন্দ ছিলাম। আমার সচরাচর নিঃসঙ্গ শিশুর মত স্বাভাবিক গল্প তৈরি করার প্রবনতা ছিল এবং আমি কল্প লোকের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতাম। আমার একাকীত্ব ও অপর্যাপ্ত মূল্যায়ন আমাকে সাহিত্য জীবনের পথ বেঁছে নিতে সাহায্য করেছিল। আমি জানতাম যে শব্দের জাদু আমাকে টানে এবং আমার বিশেষ শক্তি আছে অস্বস্তিকর ঘটনার সম্মুখিন হবার। এ সবই ও তার সাথে আমার দৈনন্দিন জীবনের বহুমাত্রিক ব্যর্থতা আমার ব্যক্তিগত জীবন তৈরিতে সাহায্য করেছিল।
যাইহোক আমার শিশুবেলা ও স্কুলের দিনের অনেক লেখার মধ্যে মোটের উপর পাঁচ ছয় পাতা ছিল (সিরিয়াস) ভারি লেখা।আমি আমার প্রথম কবিতা লিখি চার-পাচঁ বছর বয়সে। মা আমার টুকে নিত ডিকটেসন করে করে। আমার ঠিক বিশদে মনে নেই কবিতাটি সম্পর্কে। কিন্তু ঈষৎ মনে পড়ে ওটি ছিল একটি বাঘ সম্পর্কে যার দাঁত ছিল চেয়ারের মত। আমার মনে হয় ব্লেকের ‘টাইগার, টাইগার’ কবিতার নকল ছিল আমার কবিতাটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শুরুতে আমার বয়স এগার। আমি তখন একটি দেশাত্মবোধক কবিতা লিখি যেটা ছাপা হয়েছিল একটি আঞ্চলিক কাগজে। এর দু বছর পরে আরও একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল যেটি লেখা হয়েছিল Kitchener –এর মৃত্যুতে।যখন একটু বয়স বাড়ল তখন আমি জর্জিয়ান স্টাইলে প্রকৃতির কবিতা লিখতাম। আমি একবার ছোটগল্প লিখতে গিয়ে চরম ব্যর্থ হয়েছিলাম। এ সবই ছিল আমার প্রথম জীবনের সাহিত্যিক হওয়ার কিছু ঐকান্তিক প্রচেষ্টার নমুনা।
কিন্তু এসবের মধ্য দিয়েই আমার সাহিত্যের পথ চলা শুরু। আমি এ সময় খুব সহজে, অতি দ্রুত ,নিরানন্দের সাথেও কোনকিছু লিখে ফেলতে পারতাম। স্কুলের নিয়মমাফিক কাজ ছাড়াও আমি কিছুটা কমেডি ঘেঁষা বা বিশেষ অকেশানের জন্য কবিতা লিখতে সিদ্ধহস্ত ছিলাম। একবার আমি চোদ্দ বছর বয়সে অবাক করা গতির সাথে অ্যারিস্টোফেনের অনুকরণে একটি ছন্দে পূর্ণাঙ্গ নাটক এক সপ্তাহের মধ্যে লিখেছিলাম। এছাড়া একই সাথে স্কুলের পত্রিকাগুলি সম্পদনাও করেছিলাম। এই ম্যাগাজিনগুলি ছিল কেবল বিদ্রুপ বা হাসি ঠাট্টা গোছের। এসবের পাশে পাশে প্রায় পনের বছর ধরে আর এক ধরনের সাহিত্যিক সেবায় ব্রতি ছিলাম, এক ধরনের ডায়েরি বিশেষ—যেটার অবস্থান মনের অন্তঃস্থলেই ঘুরপাক খেত। আমি বিশ্বাস করি এটি সব বালক বা বয়ঃসন্ধিকালীন বাচ্চাদের মধ্যে বিদ্যমান।
ছোট ছেলে হিসেবে আমি নিজেকে,ধরে নিন রবিনহুড ভাবতাম এবং নিজেকে অনেক মজার ও বিস্ময়কর ঘটনার হিরো রুপে কল্পনা করতাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমার গল্প আর নিজের মহিমা বন্ধনায় আবদ্ধ থাকত না। সেটি হয়ে উঠত কেবলমাত্র আমি যা কিছু করছিলাম ও দেখছিলাম তার বিশ্বস্ত বর্ণনা।সময় সময় কয়েক মিনিট ধরে এই ধরনের ছবি আমার মাথার মধ্যে দৌড়ে বেড়াতঃ ‘সে দরজা ঠেলে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। সূর্যের হলুদ রশ্মি মসলিন পরদাগুলি ভেদ করে তির্যকভাবে টেবিলে পড়ল যেখানে কালির দোয়াতের পাশেই শুয়ে রয়েছে একটি অর্ধেক খোলা দেশলাই বাক্স। ডান হাত পকেটে পুরে সে জানালার এদিক থেকে ওদিক ঘোরাঘুরি করত। আর রাস্তায় কচ্ছপের খোল যুক্ত একটি বিড়াল একটি মৃত পাতাকে ধাওয়া করছে।’ ইত্যাদি ,ইত্যাদি।এই অ-সাহিত্যিক অভ্যাস আমার পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।যদিও আমি সঠিক শব্দের নাগাল পেতে মরিয়া ছিলাম তবুও আমার মনে হত আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বাইরে থেকে কে যেন তাড়া করত এইসব বর্ণনাপ্রধান গল্প লেখাতে।আর আমার গল্পগুলির নির্মাণ ছিল আমার প্রিয় লেখকদের অশেষ ভালবাসারই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আমার যেটা মনে আছে আমার লেখার বিশেষত্ব ছিল আমার নিখুঁত বর্ণনার দক্ষতায়।
যখন আমার বয়স ষোল তখন আমি একদিন আকস্মিক আবিষ্কার করলাম শব্দের নির্ভেজাল আনন্দ।প্যারাডাইস লস্ট-এর এই লাইনগুলি—
“So hee with difficulty and labour hard
Moved on: with difficulty and labour hee”
এখন এগুলি খুব একটা নাড়া দেয়না, কিন্তু সেদিন আমার অদ্ভুত আনন্দে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল। এবং ‘he’-এর পরিবর্তে ‘hee’-এর ব্যবহার ছিল উপচে পড়া আনন্দের আস্বাদনকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল।আমার বর্ণনার দক্ষতার প্রতি প্রথম থেকেই আস্থা ছিল। সুতরাং কি ধরনের বই আমি লিখব সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল সেই সময়।আমি লিখতে চেয়েছিলাম মোটা মোটা বাস্তবধর্মী অসুখি উপন্যাস যাতে থাকবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এবং চিত্তাকর্ষক উপমা। এছাড়া থাকবে মোলায়েম প্যারাগ্রাফ যেখানে শব্দ তার মূলত অনুরণনের জন্যই ব্যবহৃত হবে।এ ধরনের লেখার উদাহরণ আমার তিরিশ বছর বয়সে লেখা ‘বার্মিজ ডেইজ’।
আমি এত সব কথা বললাম কারণ একজন লেখকের জীবনের প্রথম দিককার ঘটনা পরম্পরা না জানলে কেউ তার লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেকটা অন্ধকারে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।তাঁর বিষয় নির্ভর করবে যে যুগে সে বাস করে তার নানা স্তর ও বিন্যাসের ’পরে। একথাটি সত্য বিশেষ করে আমার যুগে যেটা ছিল উথাল-পাথাল ও বিপ্লবের সময়। আসলে লেখার আগে থেকেই লেখক অর্জন করে একটি বিশেষ আবেগ বা আসক্তি যার থেকে সে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পায় না কোনদিনই। অবশ্যই তার একটি বড় কাজ তাকে অনুশীলনের ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তার কাঁচা অভিজ্ঞতাকে শালীনতার স্তরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সে যদি প্রথম জীবনের আবেগকে গলা টিপে রুদ্ধ করে তাহলে তার লেখার আবেগটাই হারিয়ে যাবে।
পয়সা উপার্জনের কথাকে পাশে রেখে আমি মনে করি লেখার পিছনে চারটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এই চারটি উদ্দেশ্যর অনুপাতের কম বেশি হতে পারে সময় সময় একই লেখকের মধ্যে আর সেটি নির্ভর করে তাঁর বাঁচার পরিবেশের ও পরিস্থিতির উপরে।
চারটি অভিপ্রায় নিম্নরূপঃ
১। নিজেকে বড় করাঃ নিজের সম্পর্কে লোকে আলোচনা করুক, কথা বলুক, মৃত্যুর পরেও নিজেকে জীবিত রাখা বা যারা একদিন তাকে ধমক বা বিদ্রুপ করেছিল, তাদের কাছ থেকে পিঠ চাপড়ানোর লোভ। অনেকে ভান করবেন যে এটা কোন লেখকের অভিপ্রায় হতেই পারে না। কিন্তু সত্য হল এটিই সবথেকে শক্তিশালী অভিপ্রায়। লেখকদের এই অভিপ্রায়ের সাথে মিল আছে বিজ্ঞানী, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, সেনা, সফল ব্যবসায়ীদের অভিপ্রায়ের। অর্থাৎ সমাজের উচ্চ শিখরে আসীন সকলেরই ইচ্ছে এখানে এক। জনসমুদ্রের বেশিরভাগ লোক আসলে স্বার্থপর নয়। বয়স তিরিশ অতিক্রমের পর তাঁরা আর ব্যক্তি থাকে না। সমষ্টির কল্যাণের জন্য নিবেদিত প্রান। পরের জন্য তাঁরা বাঁচে।আর যারা এটি পারেনা তারা সংসারের টুকিটাকি কাজের ঘানি টানে কলুর বলদ হয়ে। কিন্তু অল্পসংখ্যক প্রতিভাবান ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির মানুষ আছেন যাঁরা জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত স্বাধীনভাবে বাঁচে। আর লেখকেরা হল এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সিরিয়াস লেখকেরা সাংবাদিকদের তুলনায় অহংকারী ও আত্মকেন্দ্রিক। এরা অর্থ উপার্জনের জন্য লেখে না।
২।নান্দনিক উৎসাহঃ বহির্জগতের সুন্দর রুপকে তুলে ধরতে বা শব্দের নিজস্ব অনুরণন ও তাদের সঠিক বন্ধনের আনন্দ কে প্রকাশ করতে অনেক লেখক প্রয়াসী। এরা আনন্দ পায় শব্দের সাথে শব্দের ঘাত প্রতিঘাতের তরঙ্গে, ভাল ও নিটোল গদ্যের বা গল্পের ছন্দে ও দৃঢ়তায়। মন ব্যকুল নিজের মূল্যবান অভিজ্ঞতাকে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। তবে নান্দনিক অভিপ্রায় অনেক লেখকের মধ্যেই ক্ষীণ বা দুর্বল। এমনকি প্রচারমূলক ও পাঠ্য পুস্তকের লেখকরাও বাঁধাধরা শব্দ বা শব্দবন্ধনীর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পান শব্দের অনুপযোগিতার কারণে।এরা পাতার মার্জিন ও অক্ষর বিন্যাসেও সুন্দরের মেদুরতাতে মুগ্ধ হন। রেলের গাইড বইয়ের উপরে যে কোন বই নান্দনিক অভিপ্রায় হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়।
৩।ঐতিহাসিক তাড়নাঃ লেখকেরা ঘটনাকে দেখে ঠিক যেমন তেমনটিই। সত্য আবিষ্কার ও সেই সত্যকে স্থায়িরুপে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যবহারের জন্য রেখে যেতে চান।
৪। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যঃ এখানে ‘রাজনৈতিক’ শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। লেখকদের কাজ পৃথিবীকে একটি নির্দিষ্ট দিকে চালিত করা। কি ধরনের সমাজের জন্য তাদের লড়াই করা উচিৎ সে সম্পর্কে অন্যের ধারনাগুলিকে পরিবর্তন করা। আরও একবার বলছি রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে কোন বই সত্যিকারের মুক্ত নয়। এই মন্তব্য, ‘যে শিল্পের সাথে রাজনীতির কোন লেনা দেনা নেই’—এটি স্বয়ং একটি গভীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
এখন এটা দেখতে হবে কিভাবে এই চারটি দিক একে অপরের সঙ্গে অবশ্যই যুদ্ধ করে, এবং কিভাবে তারা অনুপাতে অবশ্যই কমে ও বাড়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, এক সময় থেকে অন্য সময়ের ব্যবধানে। আপনার ‘স্বভাব’ আপনার প্রথম প্রাপ্তবয়সেই আপনি অর্জন করেন। আমার ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি অভিপ্রায় চার নম্বর অভিপ্রায়কে তলায় ফেলে দেয়। শান্তির ও স্থিরতার যুগে আমি লিখতে পারতাম চাকচিক্য অথবা কেবল বর্ণনামূলক বই, এবং রাজনৈতিক আনুগত্য সম্বন্ধে প্রায় অসচেতন থাকতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কি আমাকে বাধ্য করা হয়েছে একধরনের প্রচারমূলক লেখক হতে। আমি পাঁচ বছর কাটিয়েছি বেমানান একটি পেশায়। বার্মায় ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়াল পুলিশের চাকরিতে। এবং তারপর আমার দরিদ্র্যতা ও ব্যর্থতার মধ্য দিন কাটে। এ থেকেই বাড়ে আমার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক বিদ্বেষ ও ঘৃণা। বার্মার চাকরি আমাকে শ্রমজীবী মানুষদের উপস্থিতি গভীরভাবে জানান দিল। এবং এর সাথে সাথেই সাম্রাজ্যবাদের গতি প্রকৃতি সম্পর্কেও অবহিত হলাম। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা যথেষ্ট ছিল না আমার সঠিক রাজনৈতিক অভিমুখিকরনের পক্ষে।তারপর এল হিটলার, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, ইত্যাদি। ১৯৩৫ এর শেষের দিক পর্যন্ত আমি কোন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ ছিলাম। আমি ঐ সময়ে একটি ছোট কবিতা লিখেছিলাম যাতে আমার দোদুল্যমানতা প্রকাশ পেয়েছে,
আমি এক সুখি যাজক হতে পারতাম
দুশো বছর আগে জন্মালে,
ধর্মোপদেশ দিতে পারতাম চিরন্তন নরক সম্পর্কে
এবং দেখতাম আমার ওয়ালনাট গাছগুলির বেড়ে ওঠা।
কিন্তু, হায়! আমি জন্মেছি অশুভ সময়ে
এবং হারিয়েছি সে মনোরম স্বর্গ,
কারন আমার উপরের ঠোঁটে গোঁফ গজিয়েছে
এবং আজকের যাজকেরা সবাই দাড়ি গোঁফ কামানো।
———————————
স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও ১৯৩৬-৩৭ এর আরও বেশ কিছু ঘটনা আমার জীবনের ছক বদলে দেয় এবং তারপর থেকেই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি কোথায় দাঁড়িয়ে। ১৯৩৬ এর পর আমার প্রত্যেক লাইন লেখা হয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে। আমার সময়ে আমার কাছে ননসেন্স বলে মনে হয়েছিল তাদেরকে যারা তখনও চিন্তা করত যে লেখক এসব বিষয়গুলি এড়িয়ে যেতে পারে। একভাবে বা অন্যভাবে প্রত্যেকেই লিখেছেন এগুলি সম্পর্কে। এটি ছিল সহজ একটি প্রশ্ন কে কোন দিকে যাবে ও কি মাধ্যম সে অনুসরণ করবে। এবং একজন লেখক তার রাজনৈতিক পক্ষপাত সম্পর্কে যত বেশি সচেতন হবে, সে আরও সুযোগের অধিকারি হবে রাজনৈতিকভাবে খেলার। অবশ্য এর জন্য লেখককে তাঁর নান্দনিক ও বৈদ্ধিক সততার বিসর্জনের প্রয়োজন নেই।
আমি যা বিগত দশ বছর সব থেকে বেশি করে করতে চেয়েছি তা হল রাজনৈতিক লেখাকে একটি শিল্পের রুপ দেওয়া। আমার লেখার শুরু সবসময় একধরনের অবিচার থেকে।আমি যখন একটি বই লিখতে বসি আমি তখন নিজেকে বলিনা যে ‘আমি একটি শিল্পের বস্তু সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’ আমি বইটি লিখছি কারন আমি মিথ্যাকে নগ্ন করতে চাই, কিছু জিনিসের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, এবং আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য শ্রোতা পাওয়া।কিন্তু আমি একটি বই অথবা লম্বা একটি ম্যাগাজিন নিবন্ধও লিখতে পারতাম না যদি না এটি নান্দনিক অভিজ্ঞতা হত।যে কেউ যদি আমার লেখা পরীক্ষা করে তাহলে দেখবে যে আমার নির্ভেজাল প্রচারমূলক লেখাটিও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। আমি সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে পারিনি বা চাই নি আমার ছোটবেলার অর্জিত পৃথিবী সম্পর্কে ধারনা। যতদিন আমি জীবিত থাকব ও সুস্থ থাকব আমার দৃঢ় অনুরাগ থাকবে গদ্যের স্টাইল সম্পর্কে, ভালবাসা থাকবে পৃথিবীর মাটির প্রতি। আর আমি আনন্দ নেব কঠিন বস্তুতে এবং টুকরো টুকরো মূল্যহীন তথ্যে।আমি আমার এই দিকটি কখনও চেপে রাখতে চাইনি। আমার কাজ হল আমার মৌলিক ভাল লাগা মন্দ লাগাগুলিকে যা কিছু জনসাধারণের বা ব্যক্তিবহির্ভূত কাজকর্মের পাশে ফেলে মিলনের জায়গায় নিয়ে আসা।
এটি সহজ নয়। এটি জন্ম দেয় গঠন ও ভাষার সমস্যা সমূহ।আরও এটিু অন্য নতুন উপায়ে তৈরি করে সত্যতার সমস্যা।আমাকে শুধু একটি উদাহরণ দিতে দিন কিছুটা নিম্নমানের সমস্যার। স্প্যানিশের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে আমার বই, ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ পরিষ্কার একটি রাজনৈতিক বই।কিন্তু এটা লেখা হয়েছে নিজেকে অনেক দূরত্বে রেখে এবং ফর্ম এর কথা মাথায় রেখে। আমি এখানে কঠোর পরিশ্রম করে বলতে চেয়েছি পুরো সত্যকে আমার সাহিত্যিক স্বাভাবিক প্রবণতাকে লঙ্ঘন না করে।কিন্তু অনেক কিছুর সাথে এখানে আছে মস্ত একটি অধ্যায় ,খবরের কাগজের উক্তি, এবং এরকম আরো কিছু। এখানে আমি ট্রটস্কিদের হয়ে বলেছি যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ফ্রাঙ্কোদের সাথে ষড়যন্ত্র করার।স্পষ্টতই এই লম্বা অধ্যায়টি এক দু বছর পরে সাধারন পাঠকের কাছে আগ্রহ হারাবে এবং অবশ্যই ধ্বংস করবে বইটিকে।একজন সমালোচক যাকে আমি শ্রদ্ধা করি একদিন বললেন, ‘কেন তুমি আজে বাজে জিনিস বইটিতে ঢুকিয়েছ?এটি একটি ভাল বই হতে পারত, কিন্তু তুমি এটিকে সাংবাদিকতার পর্যায়ে নামিয়েছ।’ উনি যা বলেছিলেন তা ধ্রুব সত্য, কিন্তু ওটা না করে অন্য কিছু করতে পারতাম না। ঘটনাক্রমে আমার যা জানা ছিল তা ইংল্যান্ডের মুষ্টিমেয় লোককে জানতে দেওয়া হত—নিরীহ লোকেদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো। আমি এই ঘটনায় যদি রেগে না যেতাম তাহলে আমি এই বই কখনো লিখতাম না।
বলা যেতে পারে একই ভাবে বা একটু ভিন্ন ভাবে এই সমস্যা আবার আসলো ।ভাষার সমস্যা সূক্ষ্ম এবং তা আলোচনা করতে লম্বা সময় লাগবে। আমি শুধু বলবো সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমি চেষ্টা করেছি কাব্যিক ভাবে কম লিখতে এবং যথার্থ ভাবে বেশি লিখতে। যাইহোক আমি দেখেছি যে যখন আপনি একটি বিশেষ স্টাইলকে ত্রুটিহীন করবেন আপনি সর্বদা সেটিকে ছাড়িয়ে যাবেন। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ আমার প্রথম বই যেখানে আমি সম্পূর্ণ সচেতন ভাবে চেষ্টা করেছিলাম রাজনৈতিক ও শৈল্পিক লেখাকে একসাথে মেশাতে। আমি সাত বছর কোন উপন্যাস লিখিনি কিন্তু আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি শুরু করবো।এটি অবশ্যই ব্যর্থ হবে। প্রত্যেক বই ব্যর্থ। কিন্তু আমি জানি কি ধরনের বই আমি লিখতে চাই।
পিছনের এক পাতা বা দু পাতা লেখা দেখে আমার মনে হল যে আমার লেখার অভিপ্রায় সবটাই জনগণের উন্মাদনাকে স্বীকার করে। কিন্তু আমার লেখার শেষ ছাপ ওটি নয়। সব লেখকই অহংকারী, স্বার্থপর, অলস, এবং তাদের লেখার গভীরের উদ্দেশ্য রহস্যাবৃত।বই লেখা একটি ভয়ংকর, শ্রমসাধ্য লড়াই। এই লড়াইকে তুলনা করা যেতে পারে কোন যন্ত্রণাময় অসুস্থতার সাথে কোন রোগীর দীর্ঘ জীবন যুদ্ধের । কেউ এ কাজে হাত দেবে না যদি না তাকে একটি দৈত্য শক্তি তাড়া না করে। আর এই ডিমনিক শক্তিকে প্রতিহত করা বা ঠিকমত বোঝা যায় না। আর আমরা সবাই জানি দৈত্য এমন একটি স্বাভাবিক প্রবণতা যেটি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শিশুকে গুমরে কাঁদায়। এবং এর সাথে এটাও সত্যি একজন পড়ার যোগ্য কিছুই লিখতে পারেনা যদি না সে সবসময় নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজের ব্যক্তিত্বকে মুছে ফেলতে। ভাল গদ্য জানালার কাঁচের মত। আমি বলতে পারবো না কোন অভিপ্রায়টি আমার সবথেকে প্রকট, কিন্তু আমি জানি কোনটি সম্মানের দাবি করে অনুসরণ করার। এবং পেছনের দিকে তাকালে দেখি যে সর্বদাই যেখানে আমার রাজনৈতিক অভিপ্রায় প্রকট ছিল না সেখানে আমি লিখেছিলাম মৃত বই, এবং সেখানে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মোলায়েম পাতার পর পাতা, অর্থহীন বাক্যসমূহ, আকর্ষক বিশেষণ, ও শূন্য গালভরা কথা।
(প্রথম প্রকাশ, সহমত, সম্পাদক, সুবিদ আব্দুল্লা, জানুয়ারি ২০২০)