সবে সন্ধ্যা নেমেছে।আকশের গা বেয়ে তারাদের ফুল ফোটেনি এখনও।আর ফুটলেও দেখার উপায় নেই। ট্রাকের অনবরত যাতায়াতে চারিদিক ধূলাময়।অবশ্য কৃষকরা ওসব গায়ে মাখে না। মাখলে কি আর চলে। এখনই তো দু পয়সা ঘরে তোলার সুযোগ।বছরভর তো এরা সব হা পিত্তেশ হয়ে দিন গোনে এই দিন কয়েকের জন্য।
যেদিকে চোখ যায় সে একই অনবদ্য দৃশ্য। আলুর অজস্র বস্তা নিপুন শিল্পীর হাতে পড়ে মাঠে অতন্দ্র পাহারারত। বেশি তো নয়, মাস খানেক আগেই মাঠ ছিল সবুজ কার্পেটে আচ্ছাদিত। আর আজ সব ধূলাময়। মাটির সাথে এদের টক-মিষ্টি সম্পর্ক।ফসল বুনতে মাটির উপর রুক্ষ হাতে ফালা চালায়। আবার সেই ফসল ঘরে তুলতে সেই মাটির সাথেই কি ছেনালিপনা! দলে, মসে, গতরে মেখে সবাই কি আল্লাদিত! আর হবে নাই বা কেন?মাটি যে তাদের বড় একান্ত আপন, চিরায়ত নিভৃত আশ্রয়। সুখে দুঃখে এর সাথে খুনসুটি করা যায়। ঘৃণা করে বেশিদিন দূরে থাকা যায় না। ভালাবাসার টান এতই প্রখর।তাই মাঠের দিকে একবার দেবেনের না গেলে ভাত হজম হয় না। পেট গুঁড় গুঁড় করে। যেন মনে হয় বেঙাচিরা সব পেটের মধ্যে কিল বিল করছে।
দেবেন এবার পাঁচ বিঘা আলু গেড়েছে।এখন তুলতে শুরু করেনি। মেয়ে সমুত্ত হয়েছে। পাড়ার লোকের নানা কথা সকালে বিকেলে কানে আসে।আর দেরি করা ঠিক হবে না। সময় থাকতে থাকতে একটি যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে বুকের পাথর নামে।যাক ধ্বসার হাত থেকে রক্ষা হয়েছে। গেলবার তো একবস্তাও ঘরে আনতে পারেনি। এদিকে মহাজনের সুদ চড় চড় করে বাড়ে। কি করবো, কি করবো করে দুধের শ্যামলী কি বিক্রি করে দেবেন সে যাত্রায় রেহায় পায়।বাড়ির গিন্নির সে কি কান্না। বিক্রি করা কথা হতেই শ্যামলী জাবর কাটা ছেড়ে দিল। চোখের সেই ফনে ফনে চাহনি নেই। কেঁদে কেঁদে চোখের তলে কালি পড়েছে।জাব্বার যেদিন নিয়ে গেল শ্যমলীকে দেবেনের বৌ সারাদিন সারারাত একটি দানা কাটল না। রান্না বন্ধ। মিরা খুঁটিতে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চোখের জলে গা ভিজিয়েছিল। আমি এমনি হতভাগা যে সেদিন জাব্বার কে ফেরাতে পারি নি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে দেবেন আলুর হলদে পাতায় হাত বুলাচ্ছিল। যাক এবার ঈশ্বর মুখ পানে চেয়েছে।আলুর ফলন এত হয়েছে যে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। সবাই বলছে দেবেনের এবার পোয়া বারো। সব কু নজর। কু নজরের পাল্লায় কি না অঘটন ঘটে। দিন কাল ভালো নয়। একটু তাকে তাকে থাকতে হবে।
মধু মাস্টারের জমি।একবছর আগে থেকেই অগ্রিম নেয়। না হলে অন্য কাউকে দিয়ে দেবে। লিজ নিতে বেশ ভালই দিতে হয়েছে মাস্টারকে।খুব কৃপণ। পয়সা ছাড়া এক পা নড়ে না। এমনি মানুষটি সরল সাদা। বিপদে আপদে খোঁজ খবর করে।কথা দিয়ে হাজার সাহায্য ও পরামর্শ দেয়। কিন্ত হলে কি হবে শ্যালা বহুত কিপটা।এবারই তো জমিটা হাতছাড়া হয় আর কি। দেবেন বলে সাত হাজার, আর গিরিন হাঁকে আট।দেবেনেরও জেদ কম নয়। বছর বছর মাস্টারের জমিতে আলু সে করে আসছে। আর এবার তা হাত ফস্কাবে। রক্ত টগবগ করে ফুটল। সেও আট হেঁকে দিল।অমনি জমি তার হাতের মুঠোয়।
বাপের সে কিছুই পায়নি। কেবল একটু ভিটে আর কয়েকটি সুপারিগাছ আর শিমুলগাছ। ভাই বোন মিলে দশটা। বাপকে দোষ দিতে পারে না। পাঁচ বোনের বিয়ে, মায়ের চিকিৎসা করতেই সব বিক্রি করতে হয়েছে। মনে দেবেনের ক্ষোভ নেই। রোগ ব্যাধি নেই। সংসার ছোট।
দেবেন ভাবে—মেয়ের বিয়ে দিলে আর থাকে ছোট ছেলেটি। মাধ্যমিক দেবে এবার। তাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় ঢের পড়ে আছে।কিন্তু মিরাকে আর ঘরে রাখা যাবে না। দিনকাল ভালো নয়। হাতে হাতে মোবাইল। এই তো কয়দিন আগে ওর এক মেয়ে বন্ধু ট্রেনের তলায় গলা দিলো। বাড়িতে শোকের ছায়া। বড় ঘরের মেয়ে। বাপ মা দু জনেই চাকরি করে। কিছুর অভাব ছিল না। মেয়েটির সাথে মিরার ভাব ছিল। বাড়িতে আসত। গলপ করতো। দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এই প্রাণবন্ত হাসিখুশি মেয়ে ট্রেনের লাইনে গলা দেবে। কিন্তু কপালের লেখন তো কেউ খণ্ডাতে পারবে কি?
“দেবেন, বাড়ি আছো নাকি?” গলা খ্যাকারি দিয়ে জাব্বার ডাকে।
“কে?” দেবেন সবে আলুর ক্ষেত থেকে ফিরে পায়ের কাদা কলতলাতে পরিষ্কার করতে বসেছে।দুপুরে এক পশলা ফির ফির করে ঝরেছে। আকাশের মর্জি খুব একটা ভাল ঠেকছে না। সন্ধ্যায় সূর্য পাটে গেলে দেবেনের গায়ে কমলা আলোর ছটা লাগে। পাশের বাঁশ বাগানে সাদা বকের ঢল নামে।ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম মোলায়েম আলোতে বকগুলি ঝাঁকে ঝাঁকে খানিক সাঁতার কাটে। মন উদাস করা সেই দৃশ্য আজ কোথায়? আকাশ ঘুম মেরেছে। সূর্যের দেখা নেই। কি রকম আবছা আবছা অন্ধকার চারিদিকে। থম থমে ভাব একটা। ম্যাড়মেড়ে। এরি মধ্যে শালা জাব্বার হাঁকে কেনে? শ্যামলী নেই। দেবেন কতবার ভেবেছে যে কিছু পয়সা হলে একটি বকন বাছুর সে কিনবে। জরাজীর্ণ হলেও চলবে। নিজের হাতে ঘাস, খইল, বিচালি খাইয়ে নাদুস নুদুস করার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু সে সব কিছুই তো হয়ে উঠলো না। কি মতলব কি জানি! তাহলে কি বকনার খবর দেবে। ভালই হবে। কদিন পরেই তো আলু উঠবে। মাস্টারের, সারের, জলের, কামলার খরচ পত্তর সব বাদ দিলেও বিঘা প্রতি দশ তো থাকবেই।
“জাব্বার। খবর সব ভালো? বস। এই মা, চেয়ার টি নিচে আন। পান-সুপারির থালি দে।” দেবেন বন্ধুকে আপ্যায়ন করে।
“কানার আবার দিন রাত! আছি একরকম। বা, তোর সুপারি তো ভালো হয়েছে।কথা পাকা হয়েছে নাকি?” জাব্বার গাছ দেখে সুপারির ওজন মেপে নেয়।
জাব্বার আর দেবেন সমবয়সী। পাশা পাশি বাস। ওঠা বসা সবিই চলে।জাব্বার পান মুখে পুরে পকেট থেকে খৈনির প্যাকেট বের করে। এক চিমটে নিয়ে এক অসাধারণ কায়দায় তালুর উপর ডলে আর থাবা দেয়। সাথে দুএকটা হাঁচিও।দেবেনকে তার ভাগ দিয়ে বাকিটা সে মাড়ির এক পাশে রেখে পান চিবায়, আর পিচ পিচ করে পিক ফেলে আর সুপারি গাছের দিকে তাকায়। অন্ধকার হয়ে আসছে, ভাল ঠাহর হয় না আর।
“না, খালেক কালকে এসেছিল।ওই পর্যন্ত।”
“খবরদার বন্ধু। ফাঁদে পা দিওনা। খালেক হারামির ব্যাটা হারামি। যে বাড়ি যাও যা কিনতে যাও ওই শালা খালেক। গরু, ছাগল, মুরগি, সুপারি, আলু, কেরোসিন, গাছ, সবেতেই সে আছে।হমন্দির অত্যাচারে দেশ ছাড়তে হবে দেখছি!” সুপারির থোকায় তাক করে সে কথাগুলি আওড়ায়। আর মনে মনে কি সব হিসেব কষে।
“তা, তুমি কি সুপারির জন্য এই সাঁঝে আমার বাড়িতে হানা দিলে?”
“ছিঃ ছিঃ দেবা, এ সব কি কথা। আরে জমিরেরে চায়ের দোকানে বসেছিলাম। তুই তা জানিস চায়ের আমি পোকা। সবে চায়ে চুমুক দিয়েছি। আর এক ভদ্দর নোক পাশে বসা।প্যান্ট-শার্ট-জুতা পরা, চোখে মিহি কাঁচের চশমা।ছেলের বিয়ে দেবে।মেয়ে দেখছে। মনের মতো হচ্ছে না। ফর্সা তো হাইট কম। হাইট আছে তো গায়ের রঙ চাপা। টঙ করে আমার মাথা খেলে গেলো। আরে আমাদের মেয়ে তো সবদিক থেকে ফিট। আমি কটা দিন ধার চেয়েছি। ভদ্দর নোক রাজি।”
এসব কথা শুনে মিরা লজ্জা পায়। সে ঘরের ভিতরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।মাথা এপাশ ওপাশ ঘুরায়। চুল চিরুনি দেয়।
“ছেলে কী করে, বন্ধু?” দেবেন আমতা আমতা করে শুধায়।
“আরে, ছেলের কথা বাদ দে। বাপের এক ছেলে। সামনে পিছনে, ডাইনে বায়ে কেউ নেই। ভদ্দর নোক চাকরি করে। মোটা মাইনে পায়। জমি জায়গা, পুকুর, চা বাগান সব আছে। এলাহী ব্যপার!”
“কিন্তু আমাদের গরীব ঘরে…?”
“গরীব, বড়লোক কথা নয়। ওরা মনের মতো শিক্ষিত মেয়ে চায়।”
“আচ্ছা।কিন্তু ছেলে কি করে জানলে ভালো হতো না বন্ধু?”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওসব জানা যাবে। একটা দিন ঠিক কর।আমরা একবার ঘুরে আসি।তুই কি বলিস?”
“ঠিক আছে। তাই হবে।” দেবেন উৎসাহ না দেখিয়ে শুকনো মুখ করে বলে।
“ঠিক আছে। আসি। হ্যাঁ আলু হোক, সুপারি হোক আমাকে দিস। খালেকের নরম কথায় গলিস না।” ধুর মুড় করে বেরিয়ে বিড়িতে টান দিতে দিতে সে বাজারের দিকে সাইকেল ঠেলে।
সেদিন সন্ধ্যায় দেবেন আর হাটে গেল না।মনের ভিতর হাজার কথার আনাগনা। মিরাকে যেভাবে হোক ঘাড় থেকে নামাতেই হবে। বয়স বাড়লে শরীরে ভাটা নামবে । ছেলে পাওয়া আরও দুষ্কর হবে। জাব্বার-এর নিয়ে আসা সমন্ধের কথাটি মিরার মাকে পাড়ি। কিন্তু ছেলের কাজকর্মের একটু খবর না নিয়ে বিয়ে! না না এটি ঠিক হবে না। দেবেন উঠানের এক কোনে বসে বিড়ি টানছে আর নিবিড় মনে এসব কথা ভাবছে। আকাশে তারার ঢল নেমেছে। চারিদিকে সুপারি গাছ, কলা গাছ। আর সর্বত্রই ছোপ ছোপ কেমন যেন মায়াবী অন্ধকার।
শোবার আগে কথাটি পাড়লে মিরার মার ধুকপুক বেড়ে যায়।শরীরে মোচড় লাগে। পুলকের না বিষাদের সে বুঝতে পারে না। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। বড়লোকের ঘরের বৌ হবে। সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করবে। মায়া করে কী হবে? সমুত্ত মেয়ে। ঘরে তো সারাজীবন রাখা যাবে না। ঠাকুর যেন মুখ তুলে তাকায়। আলুর ফলন বেশ হয়েছে। ও কে দেখে সবাই হিংসা করছে। এখন বাজার ভাল হলেই সব কষ্টের শেষ।
“হ্যাঁ গা, ছেলে কী করে?”
“বড়লোকের ছেলে। ছেলের বাবা চাকরি করে। মোটা মাইনে পায়। দশখানা ঘর, চা বাগান, জমি, পুকুর সব আছে।”
“তাহলে আর দেরি কিসের? কালকেই একবার সব দেখেশুনে দিনক্ষণ ঠিক করে আসো। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। আমরা গরীব। বেশি কি আর পড়াতে পারবো? তাছাড়া আলুর ফলন বেশ ভাল এবার। যদি একটু দাম ওঠে তাহলে খুব একটা কষ্ট হবে না।”
ভোরের মোরগ ডাকতেই দেবেনের ঘুম ভাঙ্গে। ভোরের হাওয়ায় দেবেনের গা কাঁটা দেয়।বাতাসে শীত শীত ভাব।চাঁদ পাংশুটে।তারাগুলি নিস্প্রভ।
হাল্কা শিশিরের প্রলেপ আলুর জমিতে। দেবেন এদিক ওদিক তাকায়। শুধু আলু আর আলু। কেউ তুলতে শুরু করেছে। কেউ কেউ এখনও অপেক্ষা করছে মুনিষের জন্য। আল দিয়ে চলতে গিয়ে দেবেনের পা শিশিরে ভিজে চপ চপ করে।তখনও পাখিদের কোলাহল শুরু হয় নি। শুধু কয়েক ঝাঁক বক ও শালিক সকালের নিস্তব্ধতার অন্তরায় ঘটিয়ে আকাশের গা বেয়ে উড়ে গেল খাবারের খোঁজে।
পূর্বদিকের আকাশ সবে লালচে হতে শুরু করেছে। চাষিরা দু একজন মাঠে আসছে।ভীষণ ব্যাস্ত।আলুর সিজন। ছেলে বুড়ো সবাই হাত লাগিয়েছে আলু তোলার কাজে।ভোর থেকে ঘোর মাটির বুক চিরে জীবনের আশার দ্বীপ জ্বালার মরীয়া চেষ্টা। শরীরে ক্লান্তি এলেও কেউ গায়ে মাখে না। একা তো নয়। দলে দলে, গল্পে, গানে, কটু কথায়, হাসিতে সবাই যেন মাতোয়ারা।হাতে পায়ে ধূলার আস্তরণ, কাপড় চোপড় সব সাদা, এমনকি চোখের ভুরুও। কেমন যেন অপার্থিব লাগে। প্রথমে হাতে, আর হাত ব্যাথা হলে, ফেটে গেলে, পায়ে মাটি খোঁড়া। সূর্য মাথায় সুধা-আগুন বরষ করে আশীর্বাদ দেয়। আর এরা মহানন্দে কিলবিল করে যেমন করে গরম কড়ায়ে পিঁপড়েরা করে।
এ এক বাৎসরিক উৎসব। আলু চাষিদের তো বটেই, পাড়ার মুদির , কাপড়ের দোকানিদেরও। এই কৃষকরাই তো তাদের মূলধন। আলুর ফলন আর দামের উপর এ অঞ্চলের ব্যাবসায়িকরা নির্ভর। এমনকি মাছ, দুধ, ফলমূল বিক্রিও।
দেবেন তড়িঘড়ি করে জমির আল ধরে একবার হাঁটে। কিন্তু হাঁটা কী অত সহজ! আলুর হলদে ডগাগুলি তার পা জড়িয়ে ধরে। সে বাঁধা পায়। কিন্তু পায়ে মাড়াতে ভয় পায়। কী করে সে মাড়াবে।মাটি নরম করে, চিরুনির বিলি টেনে সে আলু গেড়েছে। ক্ষীদে ভুলেছে, ভুলেছে শরীর। দিনের পর দিন মাটির সাথে কামড়া কামড়ি করে তাকে বশ করেছে। সার, সেচ, তেল দিয়ে তিলে তিলে বড় করেছে সন্তান সম। এদেকে কি পায়ে মাড়ানো যায়? তাই সে হাঁটু মুড়ে পাশে বসে, ডগাগুলিতে আলতো করে গায়ে, মাথায় হাত বুলায়, শরীরের ওম দেয়, ও অবশেষে পা বাড়ায়। এই করে বেশ খানিকটা বেলা হয়। তার হঠাৎ জাব্বারের মুখ মনে পড়ে। সে বাড়ির দিকে দ্রুত পা বাড়ায়।
দুই বন্ধু সন্ধ্যার আগেই সাইকেল মেরে শিবপুর পৌছায়।গ্রাম হলেও খুব ছিম ছাম। মানুষ জনের অবস্থা ভালো। মাটির বাড়ি নেই। দু একটা টিনের। বেশিরভাগ দোতালা।
“সুরেন বাবুর বাড়ি কোনটি?” জাব্বার শুধায় পাড়ার চৌমাথা মোড়ের মাচায় বসে মোবাইল ঘাটা একটি ছেলেকে।
“ডানদিকের রাস্তায় গিয়ে তিন নম্বর।” ছেলেটি মুখ না তুলে উত্তর দেয়।
বিশাল বাড়ি। গেটে ঢুকেই মন্দির। পেছনে বাগান ও পুকুর। চা পানের পর কথা বার্তা উঠল। ছবি দেখে মেয়ে সকলেরই পছন্দ। এ বাড়িতে মেয়ে দেওয়া তো কপালের ব্যাপার। দেবেনের মনে ভয় ও সমীহ দানা বাঁধে। কাঁধে কাঁধ না মিললে কী করে হবে।দেবেনকে চিন্তিত দেখে সুরেন বাবু অভয় দেন, “আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আর টাকা পয়সার কথা তো একদম ভাববেন না।আমার একছেলে, খাবে কে?”
তারা আনন্দে বাড়ি ফেরে।
“কী খবর,ছেলে কেমন দেখতে, বাড়িঘর?”
“বৌ, সত্যিই ভগবান এত বছর পরে চোখ তুলে তাকিয়েছে।সোনার ছেলে গো, সোনার ছেলে।বিরাট ব্যাপার। দশ বারো খানা ঘর। মা আমার কোথায় শোবে আর কোথায় খাবে, কোথায় টি ভি দেখবে বুঝতেই এক বছর পেরিয়ে যাবে। আগের দুটো সম্বন্ধ নষ্ট হয়েছে, বেশ হয়েছে। কথায় বলে না, সবুরে মেওয়া ফলে।”
“আর এক হাতা দিই, একটু ডাল…”
“আর ধরবে না। বেশ খেলাম।পেট ঢোল। অনেকদিন পর। মনটা বেশ হাল্কা লাগছে।” দেবেন ঢেকর তোলে।
“ছেলে কী করে?”
“অই তোর এক কথা! ছেলে ধুয়ে কি জল খাবি,” দেবেন রেগে বলে। “ছেলের যা আছে, যদি বেচেও খায় তাহলে চোদ্দ পুরুষ বসে খাবে। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ কিসের?নিজের না আছে দু কাটা জমি। মাস্টার আছে বলে তো বছরে আলু, ভুট্টার মুখটা দেখতে পাস।অত কিসের? বাড়িতে চারটে কাজের লোক। রান্না করতে হবে না, বাসন মাজতে হবে না, পায়ের উপর পা তুলে খাবে। এর থেকে আর সুখ কিসে আছে?”
“তুমি খামোখাই খ্যাও খ্যাও কর। মুখে কোনদিন নরম কথা নাই।” মুখ ভার করে দেবেনের বৌ বসে রইল।
“আহা, রাগ করলে? এখন এ বয়সে কী রাগ মানায়। সামনে কত কাজ। আলু ঘরে তুলতে হবে, কত কিছু জোগাড় করতে হবে। কিছু না দিই, মেয়ের গহনা, ছেলের বাইক। তাছাড়া গ্রামের মান্যগণ্য কয়েকজনকে তো বলতে হবে। আমি এসব ভাবছি। আর তুমি কিনা ছেলের পেছনে পড়ে রয়েছ। ছেলে কী করে? ছেলে কী করে? ছেলে বসে খেলেও তোর মেয়ের মতো চার পাঁচটিকে সোনার হালে রাখতে পারবে।”
দেবেনের মনে নানা যোগ বিয়োগ। কিছু আসবে সুপারি থেকে, বেশিটা আসবে আলু থেকে। আর এর পরেও যদি না হয় তাহলে সে বাড়ির পেছনের শিমুল গাছকটাও জাব্বারকে দিয়ে দেবে। মেয়ে বড় ঘরে যাবে। এটুকু তো করতেই হবে। এসব ভাবে আর দেবেন দিন গোনে। সকালে আলুর জমিতে, দুপুরে সুপারিতলায়, আর পড়ন্ত বিকেলে সে শিমুলগাছগুলিকে জরিপ করে। মন সময় সময় হু হু করে জ্বলে, আবার মেয়ের মুখ মনে পড়লে সব ব্যাথা নিমেষে উধাও।ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর জুড়ায়।
কয়েকদিন পর জাব্বার ছেলের বাড়িতে মেয়ে দেখার দিন পাকা করতে যায়। সবাই জাব্বারের মুখের দিকে তাকায়। কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু মুখ খুলছে না। সে জোর করলে জানতে পারে ছেলের অনেকদিনের শখ একটি চার চাকার। তারা অনুতাপ করে যে সে দিন কথায় কথায় তারা এটি বেমালুম ভুলে গিয়েছে। ছেলে এখন জেদ ধরেছে। চার চাকাটি যদি…
দু দিন মুষলধারে বৃষ্টি। মাঠ জলে থই থই। দুপুরে অনেকে মাছ ধরছে। চাষিদের মাথায় হাত। আলুর জমি জলের তলায়। জল সরলে কেউ কেউ পচা আলু ঘরে আনে। কিন্তু গন্ধে ঘরে থাকা দাই।কেউ কেউ রাগ করে বিড়ি ধরাই আর হাঁটে গিয়ে যাকে সামনে দেখে তার হাত ধরে বলে, ‘সম্নধির এই কাজ কী মানুষে করে। আলু কি মানুষে লাগায়। সর্বনাশ! ভাই সর্বনাশ! মহাজনের টাকা, সারের টাকা… শালা বৌ মেয়ে সব বন্ধক রাখতে হবে!’
দেবেন বাড়িতেই থাকে। কথা বন্ধ। শুধু সুপারিতলায় বসে থাকে আর আকাশের দিকে তাকায় আর কি সব বিড় বিড় করে। লোকে বলে ওঝা ডাকতে হবে, না হলে এ ভূত সুপারিগাছ ছাড়বে না।
“দেবেন বাড়ি আছো?”
“অনেকদিনের চেনা গলা মনে হচ্ছে।দেখ মিরা কে?” দেবেনের বৌ কলতলা থেকে মিরাকে ডাকে।
“মা। জাবু কাকুউউউউ…” মেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।