মুরলি শক্ত করে পুরনো শত ছিদ্র লেপটি গায়ে জড়িয়ে নগ্ন জরাজীর্ণ খাটিয়ায় গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো। আশা যদি ঠাণ্ডা একটু কম লাগে। ইচ্ছে করলে সুতির চাদরটি যেটিকে সে মাথার বালিশ হিসেবে ব্যবহার করেছে লেপের ওপরে চাপিয়ে নিতে পারে। আজ মারাত্মক ঠাণ্ডা পড়েছে। তার গরীব বাবা রাজ্জু আট বছর আগে মরার সময় রেখে গেছে খড়ের একটি চালা, দুটি ছেঁড়া লেপ, চারটি শুয়োর আর ছটি জমিদার বাড়ির হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। বৃষ্টি বুঝি আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। শালা তার সাথে ঝড়ো বাতাস পাল্লা দিয়েছে।দমকা হাওয়ায় দরজার ঝাপটি উড়ে গেল আর বৃষ্টির ছাঁটে মুরলির তাকিয়া এখন কুকুর ভেজা। গুমড়ো আকাশে থেকে থেকে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের ঝলক। মুরলি বিরক্ত হয়ে উঠে হাতড়ে হাতড়ে লম্ফটি ধরালো আর এপাশ ওপাশ দেখতে থাকে। সে ছুটে গিয়ে ঝাপটি নিয়ে আসে ও দরজার মুখে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। ঠাণ্ডায় হাত পা কাঁপছে। সে তাকিয়াটি ঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে ঠেলে দিলো। তারপর চাদরটি ভালোকরে গায়ে জড়িয়ে থুতনি হাঁটুতে রেখে জড়োসড়ো হয়ে বসে। তার বিড়ি ধরাতে ইচ্ছে হলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখে একদম ফাঁকা। মনে পড়ে শেষ বিড়িটি সে সন্ধ্যায় শেষ করেছে। তার মা তখনও গুটি মেরে এক কোনে মরার মতো পড়ে রয়েছে। কেন মা উঠছে না, সে ভাবে। ভয়ে কাঠ। ছুটে এসে মার কপালে হাত বুলায়। একটি দুটি হাঁচি দেয়। মুরলি জান ফিরে পায়। সে তার লেপটি মায়ের গায়ে জড়িয়ে দেয়। হঠাৎ ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুরলি বুঝতে পারলো না যে লম্ফটির কেরোসিন ফুরিয়েছে না এটি দমকা বাতাসের কেরামতি। তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। এভাবে ঝড় বইলে তার চালাটি উড়ে যাবে। খড়গুলো পচে এসেছে। দড়ির বাঁধনগুলিও। মেরামত আমাকে করতেই হবে। আর ফেলে রাখা যাবে না। সকালে সূর্য উঠলেই আমি লম্বা ঘাসের ব্যবস্থা করে নোতুন দড়ি দিয়ে ভালো করে মেরামত করবো। না, এভাবে আর বাঁচা যাবে না। সকাল হলেই…এক বর্ষা ও এক শীত অন্তত নিশ্চিন্ত! মুরলি চালার কোনে বসে বসে এসব চিন্তার নিবিড় ঘেরাটোপে হারিয়ে যায়।
রাজ্জু বেঁচে থাকতে মাটির দেওয়াল হোক বা চালা মেরামতের কাজ হোক সে একাই সব সামলে ফেলতো। সে মারা গেলে তার বৌ এসবের দায়িত্ব নেয়। মুরলি কেবল শুয়োরের খাঁচাটিতে হাত লাগিয়েছিলো। তাও তার মার বারংবার ধমকের পর। তিনদিন লেগেছিলো। কিন্তু শেষে মুরলির হাতের কাজ দেখে তার মার বুক গর্বে ভরে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে মুরলি একটু উষ্ণতার ওম পায়। তার মনে পড়ে একবার সে তার বাবাকে গ্রাম ছাড়ার জন্য বলেছিলো। বলেছিলো তার আর রোজরোজ একই কাজ—শুয়োর চরানো আর জমিদার বাড়িতে ও তাদের মাঠে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করতে ভালো লাগে না।একাজ সে ঘৃণা করে। সে মিলে কাজ করবে। শুনে তার বাবা রেগে একেবারে লাল। ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো, “মিল কি তোর বাপের? তোর তো জমিদারদের ঘরে জন্মানোর কথা! লাটের ব্যাটা এসেছে রে!হু…”
মুরলি সেদিন আর তর্ক করেনি। সে একমনে পায়ের আঙুল দিয়ে মাটিতে আঁচড় কেটেছিলো। বাবার রাগ সে ভালো করেই চেনে। “কথা না বাড়িয়ে ঝুড়ি হাতে তোল এখনি আর আমার সঙ্গে পা ফেল,” তার বাবা জামার হাত গুটাতে গুটাতে কটমট করে তাকিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলো।
রাজ্জু সময় সময় অবাক হয় আর ভাবে কে তার ছেলের মাথায় এসব ঢুকিয়েছে। অন্যান্য সাফাইবালাদের ছেলেরা তো কই এরকম কথা কেউ বলে না। মুরলির অবশ্য একবার মৃগীরোগ দেখা দিয়েছিল। তারপর থেকে রাজ্জুর খুব চিন্তা। গ্রামের বৈদ্য সারাতে পারে নি। মৌলবি সাহেবের তুকতাক কোন কাজে আসে নি। সেজন্য সে মুরলিকে কখনো একা ছাড়ে না। জমিদার বাড়িতে গেলেই সে তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। এই তো দুমাস আগেই মুরলি একদিন নর্দমায় পড়ে যায়। কয়েকঘন্টা সে সেখানেই পড়ে থাকে। রাজ্জু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার হদিস পায় নি। শেষে কে একজন তাকে খবর দেয়। এরপর থেকে রাজ্জু আর মুরলিকে কাছ ছাড়া হতে দেয় না। সারাক্ষণ আগলে রাখে। মৃগীরোগ মুরলিকে অনেকটা কাবু করে দিয়েছে।ফলে সে বিছানায় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। মুরলির এই অবস্থা দেখে ওর মা খুব কষ্ট পায়।
খামারে শুয়োরগুলো ঘোঁতঘোঁত করছে অবিরত। আর মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। বেচারিরা ক্ষুদার্ত। গতকাল দুপুর থেকে একভাবে খামারে বন্দী।
‘শুয়ে থাকি। আপতগুলোর বাড় এবার ঘুচেছে।’ মুরলি শুয়োরগুলোকে গালি দেয়।
আসলে শুয়োরগুলো চৌধুরীর আখ খেত নষ্ট করেছে। চৌধুরীর ছোট ছেলে তাকে যা তা বলে গালিগালাজ করেছে। সে যদি বাপ মা বলে চৌধুরীর পায়ে না পড়তো তাহলে হয়তো তাকে আজ আর খুঁজে পাওয়া যেত না। মোরগের ডাক কানে আসে। সে বাইরে আসে। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ মেঘলা। আবছা আবছা অন্ধকার চারিদিক। সবাই এখন বাড়িতে। এই সুযোগে ভয়ে ভয়ে সে শুয়োরগুলো ছেড়ে দেয়।
‘যা হবে দেখা যাবে। আমি ওদেরকে না খেয়ে মরতে দিতে পারি না।’ মনেমনে মুরলি বিড়বিড় করে।
এবার সে কতকগুলো কাঠি এদিক ওদিক থেকে জোগাড় করলো। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো মা তার অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে। এই সুযোগে চালের কয়েক গোছা খড় টেনে সে তাতে দেশলাই ঠুকে কাঠিগুলোর তলায় রাখলো। আগুন কিছুতেই ধরে না। ধরবে কী করে? সব তো ভিজে স্যাঁতসেঁতে। ফলে চারিদিক ধোঁয়াতে ভরে গেলো। তার চোখ জ্বালা করছে।এদিকে খড় পুড়ে শেষ। রাগে সে গরগর করছে। জোরে এক লাথি মারলো কাঠিগুলোতে আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। গ্রামের শেষে আখ মাড়ার কল। লালা রতি রাম এটির মালিক।সে লালাকে মাথা নত করে সম্মান জানালো।টাটকা গুড়ের সুবাস বাতাসে ভাসছে। জিভে জল। তার একদলা গুড় মুখে পুরতে খুব ইচ্ছে। বেশ কিছু লোক কলে কাজ করছে। কয়েকজন মাথায় পাগড়ি বেঁধে উলের পোশাকে বসে বসে মনের সুখে হুকা টানছে। মুরলি লম্বা ঝাটাটি হাতে তুলে লালার বড় উঠোন ঝাড় দিতে লাগলো।
‘হে, মুরলি।’ রতি রাম বারন্দা থেকে হাঁকে।
‘জি লালাজী।’
‘তোর মা আসেনি আজ?’
‘মার শরীর খারাপ, লালাজী।’
‘ঠিক আছে। এটি নিয়ে যা।’
মুরলির ছোট্ট বালতি ভর্তি আখের রস দেখে খুব আনন্দ হলো। তার মা আখের রস খুব ভালবাসে। এছাড়া এক টিন গাদ জমেছে।একেবারে কানায় কানায় ভর্তি। শুয়োরগুলো গাদ খুব ভালবাসে। টিনটি মুরলি সন্ধ্যা বেলায় রেখে যায় আর সকালে বাড়ি নিয়ে আসে।যেদিন তারা গাদ খেতে পায় সেদিন তাদের দেখে কে! মুরলির আধঘণ্টা লাগলো লালাজীর উঠোন ঝাড় দিতে। সে একটু চিমনির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে। গাড়ো ধোঁয়ার মেঘ সর্পিল গতিতে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে।সে বেশ উষ্ণ অনুভব করে।
‘লালাজি গুড়!’
‘হু, হু…কেন রে?’
তার হাতের তালুতে একদলা টাটকা গুড়। মুরলি অবাক!তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। সে চেটেপুটে খেলো, তারপর কুর্তাতে হাত মুছতে থাকে। সে খুব খুশি।
‘রস নেবে কি?’ উনুনের লোকটি জিজ্ঞেস করলো।
মুরলি মৃদু হেসে সন্মতি দেয়।
‘তোর ঘটি নিয়ে আয়।’
মুরলি দেওয়ালের এক কোনে তার মাটির ভাঁড়টি লুকিয়ে রাখে। লালাজীর বৌ মাঝে মধ্যে ঘোল দিলে তখন পাত্রটি কাজে লাগে।
মুরলি ভাঁড় ভর্তি আখের রস তারিয়ে তারিয়ে পান করলো। তার পোড়া জান ঠাণ্ডা হলো। গোঁফে লেগে থাকা রস সে এখন হাত দিয়ে মুচছে।
টিনভর্তি গাদ মাথায় আর হাতে ঝোলানো আখের রসের বালতি।মুরলি বাড়ি আসে। ভাবছে মা কতদিন পর আখের রস দিয়ে খির তৈরি করবে। কতদিন সে খির খায় নি। একবছর তো হবেই। সেও তার বাবার মতো পেটভরে খির খেয়ে রোদ পোয়াবে আর ঢেকুর তুলবে।
‘মা, আজ তুই খির রান্না কর।’
‘খির!’
তার মা ও খুশি বালতি ভর্তি আখের রস দেখে। টিনও ভর্তি গাদে। ছেলে তার খুব কাজের!
‘চা খেয়ে তাড়াতাড়ি কাজে যা, বেলা হয়েছে,’ মা মুরলির হাতে চায়ের মগ ধরিয়ে দেয়।
মুরলি উনুনের পাশে বসা যদিও উনুন নিভে আছে। মাত্র কয়েকটি পোড়া কাঠি টিমটিম করে জ্বলছে। সে চা এক চুমুকে শেষ করে লম্বা হয়ে চারপয়ে শুয়ে পড়লো। ভাবখানা যেন আজ তার কোন কাজ নেই। তার মনে হলো এখান থেকে তার অনেক দূরে চলে যেতে। কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে নিজের চিন্তায় সে বুঁদ। সে ভুলে তার কষ্টের জীবনের কথা।
‘মুরলি, তুই কাজে যাবি না?’
‘যাবো, যা্বো। কেন তুই আমার মাথা খাচ্ছিস? একটু শুয়ে গড়াগড়ি মারতে দে।’
মুরলির রাগ হয় নিজের প্রতি।কেন সে এভাবে খ্যেকিয়ে কথা বললো? জগতে তার মা ছাড়া আর কে আছে। বাবার মারা গেলে মা পাগলির মতো হয়ে যায়। শরীর ভেঙে পড়ে। রোগা, পাংশুটে। বয়সের থেকে বেশি বুড়ো মনে হয়। মুরলি্র বুক যন্ত্রণায় ধড়ফড় করে। সে উঠে দেখে মা উনুনে আগুন দিচ্ছে। সে ঝুড়ি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ধেক দিন তার ছটি বাড়িতে গোবর কাড়তে ও ঝাড় দিতে লাগে। বাবা বেঁচে থাকতে তাকে ঝাড় দিতে হতো না। এখন গোবর ফেলা ও ঝাড় দেওয়া সব একহাতেই সামলাতে হয়।
কাজের শেষে কয়েকটি চাপাটি বাবুরা তাকে দেয়। সে যত্ন করে নিয়ে তা বাড়িতে নিয়ে আসে। মা ও ছেলে একসাথে বসে খেতে ও সেগুলো খায়। মা বাসিগুলো, আর ছেলে টাটকা।
‘মা তুই টাটকাগুলো কেন দিছিস?’
‘না, তুই খা। তোকে তো জমিদারদের কাজ করতে হবে। না খেলে কি করে কাজ করবি?’
সে একমনে দেখে মুরলির চাপাটি খাওয়া। সময় সময় কোন মালিকের বাড়ি থেকে সে ঘোল আনে। তার ছেলে খাবে। মুরলি খেতে খুব ভালবাসে। দেখতে দেখতে বয়স চল্লিশ হলো। আজও মা তার সব। মুরলি ঈশ্বরকে সাধুবাদ দেয় এমন দয়ালু মা তার কপালে জুটেছে ভেবে।
‘না, মা। আজ তোকে বাসি চাপাটি খেতে দেবো না,’ মুরলি মার কম্পমান হাড়গিলে হাতে টাটকা চাপাটি গুঁজে দেয়।
‘না, তুই খা। তোকে হাড়ভাঙ্গা কাজ করতে হয় তো।’
‘মা, আমি জোয়ান আছি। আমার সব হজম হবে।’
মাঝেমাঝে মুরলি ভাবে কেন বাবুরা তাকে বাসি চাপাটি দেয়। ‘আমরাও তো তাদের মতো মানুষ। আমরা তো তাদেরই বাড়িতে জমিতে খাটি।’ কোন উত্তর সে পায় না। এসব কথা মার সামনে পাড়লে মা রেগে ফেটে পড়ে।
‘তুই শুধু তোর কাজ করবি, ব্যাস। বুঝছিস?’
মুরলি তার মার রেগে লাল হওয়া মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায়। বুঝতে পারেনা মা তার কেন হঠাৎ রেগে যায়। না, আর সে কোনদিন মার সামনে মিলে বা ইটভাটায় কাজ করার ইচ্ছের কথা তুলবে না। আর তাকে কে নে এসব কাজে। সে তো মৃগীরোগী।
‘মুরলি, শোন আমার কথা। তুই এসব আবোল তাবোল চিন্তা করলে একদিন তুই পাগল হবি।খবরদার না…’
‘ঠিক আছে, মা। আমি কথা দিচ্ছি।’
মন ভার করে মুরলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুতেই এলোমেলো চিন্তাগুলোকে বাগে আনতে পারছে না। যত ভাবে চেপে যাবে ততই সেগুলো তেড়েফুড়ে বাইরে আসতে চায়। সে সব গুলিয়ে ফেলে। নিম গাছের তলায় স্থির হয়ে শুয়ে থাকে। সময় সম্পর্কে সে উদাসীন। নিজের সম্পর্কেও। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে সে এখন এক বদ্ধ পাগল।
‘কানো, তোর মুরলি পাগল হয়ে গেছে। দ্যাখ, কেমন করে তাকাচ্ছে?’ লোকেরা সব টিটকারি মারে।
‘পাগল তোরা হয়েছিস! আমার মুরলি নয়।’ মুরলির মা খ্যেকিয়ে ওঠে। এরপর গালিতে গালিতে সবার শ্রাদ্ধ করে ছাড়ে। কিন্তু পরক্ষণেই সে কেমন মনমরা হয়। নিজের বিশ্বাসে চিড় ধরে। ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে ‘সত্যিই আমার মুরলি পাগল হয় নি তো!মুরলি পাগল হলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো? বাবা নেই! সে গোবেচারা! কে তাকে দেখবে? কে তার…’
মুরলির মার চোখ জলে ভরে এলো। সে হাতজোড় করে আকশের দিকে তাকালো। তারপর মুরলির ঘুমন্ত মুখে হাত বুলায় আর মনেমনে ভাবে ‘না, না, মুরলি পাগল কেন হবে! এই তো আমার সোনার প্রশান্ত মুখ! আমার ছেলে কী পাগল হতে পারে!’
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মুরলি অলসতার ঘোর গায়ে মেখে চৌধুরী বাড়ি গেলো। প্রতি সন্ধ্যায় সে চৌধুরী বাড়িতে হাজিরা দেয়। গোবর কাড়ে, উঠোন ঝাড় দেয়। চৌধুরী তাকে চা পানি খেতে দেয়। এভাবেই দিন কাটে মুরলির। চৌধুরী বারান্দায় বসে দুধ পান করছে আর হালোয়া খাচ্ছে।মুরলিকে আসতে দেখে সে হাঁকে,
‘দুপুরে কোথায় ছিলি? চাপাটি নিতে আসিস নি তো?’
‘না, হুজুর, আসলে আমি…’
‘ঠিক আছে।’
মুরলি ভালো করে দেখলো চৌধুরীকে। জার্সি, জ্যাকেট গায়ে, সবুজ মোজা হাঁটু পর্যন্ত, মাথায় হনুমান টুপি। সে কোনে রাখা ঝাড়ুটি হাতে তুলে ঝাড় দিলো। আবর্জনার স্তুপ কুড়িয়ে দুরে একটি গাছের তলায় ফেললো। গোয়াল ঘর পরিষ্কার করলো। চৌধুরীর বাড়ি এখন ঝকঝক করছে।
‘চৌধুরী সাব, আমি কি বাইরে রাখা আবর্জনায় আগুন ধরাবো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
মুরলি কিছু শুকনো ডালপালা আবর্জনার উপর রাখলো। তারপর একগোছা শুকনো বিচালিতে আগুন ধরিয়ে আবর্জনার তলায় গুঁজে দিলো। অমনি চারিদিক আলোয় আলোয় ছয়লাপ।গনগনে আগুনের পাশে বসে মুরলি হাত পা সেঁকে নিলো। বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। সে খুব খুশি আগুনের তাপ শুষে। নানা কথার ভিড়ে সে কখন হারিয়ে গেলো।
‘চৌধুরী কে দ্যাখ! কী আরাম করে বারান্দায় বসে হালোয়া দুধ খাচ্ছে। উলের পোশাক জড়ানো সর্বত্র। ঠাণ্ডা ঢুকবে কোন দিক দিয়ে। কতো বড় বাড়ি! পুত্রবধূদের, নাতিনাতনিদের দেখভালের জন্য একগুচ্ছ চাকর! বিপুল সম্পত্তির মালিক! কিসের অভাব? আর আমরা! শালা, হাভাতের দল! হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর দিনের শেষে বাসি চাপাটি পেটে ঠেসে কাত হয়ে ভাঙ্গা চারপয়ায় কুকুরের মতো রাত!পেটে ব্যাথা! বাবা সবসময় বলতো গ্রাম কামড়ে, চৌধুরীদের বাড়ি কামড়ে পড়ে থাকতে। এই তো পড়ে আছি আজন্ম! শালা এ কী জীবন! এর থেকে মরণ ঢের ভালো! নরকবাস! ছিঃ ছিঃ …’
হঠাৎ মুরলি চুপ। সে একেবারে শান্ত। ঈশ্বর জানে সে কোন জগতে পাড়ি দিয়েছিলো! যখন মানুষ ইহ জগতে সুখ, শান্তি পায় না, সে তখন কল্পনার জগৎ আঁকড়ে বাঁচে। এটাই স্বাভাবিক। তার কল্পনার জগতে সে মুক্ত, স্বাধীন। যা খুশি চিন্তা করতে পারে, বলতে পারে। বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। লোকেরা তাকে পাগল বলে বলুক। কিচ্ছু এসে যায় না। এটিও সত্য, যে যখন একজন তার পাগলামির চূড়ান্ত সীমায় পৌছায়, তখন তার এ জগতের সব চাওয়ার সমাপ্তি ঘটে।
মুরলি আবার বিড়বিড় করে, ‘একদিন আমি নিশ্চয় পাবো আমার বেঁচে থাকার সব অংশ—আমার ভাগের আকাশ, আমার ভাগের সূর্যালোক, আমার ভাগের জমি, আমার অংশের বাতাস, আমার ভাগের জল—এসবই ঈশ্বর আমাকে নিশ্চিতরূপে দান করেছে। একদিন নিশ্চয় আমি…’
মুরলির পেশি শক্ত হয়ে এলো। তার মুখ কিছুটা বেঁকে গেলো। গায়ের রং ফিকে হলো।সে পাথর হয়ে বসে রইলো। তারপর সে গোঙাতে থাকে। হেঁচকি ওঠে অবিরত। সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো আগুনের সাঁজালে। পেশীর সর্বত্র খিচুনি শুরু হলো। পুরো শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। চৌধুরীর এক নাতি যে লুকোচুরি খেলছিলো উঠোনের এদিক ওদিক হঠাৎ শুনতে পায় গোঙানির শব্দ। ছুটে এসে চৌধুরীকে খবর দেয়,
‘দাদাজি, মুরলি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে…’
চৌধুরী ছুটে এসে একজন চাকরকে ডাকলো, ‘পল্টু’।
পল্টু হাতের ঝুড়ি ফেলে ছুটে এলো। সে মুরলিকে ছেঁচড়ে টেনে সাঁজালের পাশ থেকে কোনরকম সরিয়ে আনলো। মুখ প্রায় পুড়ে গেছে। হাতের চামড়া পোড়া। বুকজুড়ে ফোসকার দাপানি।
‘ছুট। হাকিমজীকে ডাক শিগগির।’
হাকিমজীর বাস গ্রামের আর এক প্রান্তে। পল্টু মরিপড়ি করে ছুটলো।
‘কি হয়েছে, পল্টু,’ হাকিমজীর কপালে গভীর ভাঁজ।পল্টুকে তার খুব চেনা। চৌধুরীর বাড়ির কেউ অসুস্থ্য হলেই সে ছুটে তাকে ডাকতে আসে। মনেমনে ভাবে চৌধুরীর কিছু হলো না তো! সর্বনাশ! গত সপ্তাহেই তো তার হাঁপানি ধরা পড়েছে। তখন থেকেই সে খুব কাশছে।
‘মুরলি আগুনে…।’
‘মুরলি কে?’
‘চৌধুরীর ঝাড়ুদার।’
‘ও, আচ্ছা।’
হাকিমজীর কপালের ভাঁজ উধাও। সে তার চেয়ারটি টেনে বসলো আর একটি ছোট্ট বোতল পল্টুর হাতে গুঁজে দিলো, ‘ক্ষত জায়গায় ঘষে দেবে।’
পল্টু চিলের মতো ছো মেরে হাকিমজীর বোতলটি ঝড়ের বেগে নিয়ে আসে। এসে দেখে মুরলির হাত পা ঠাণ্ডা।
ইতিমধ্যে দু একজন লোক জমা হয়েছে। তারা ফিসফিস করছে নিজেদের মধ্যে। তারা হাকিমজীর অপেক্ষায়। চৌধুরীকে দেখে অল্প চিন্তিত মনে হলো। মুরলি শেষ ঝাঁকুনি দিয়ে স্বর্গের পথে পা বাড়ালো।
( বি এস ত্যাগীর ইংরেজি ছোটগল্প ‘আনডাইং ড্রিম ‘-এর বাংলা অনুবাদ।)